
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এমন এক নাম, যিনি তাঁর কর্মগুণে ও ব্যক্তিত্বে বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন। একজন স্বাধীনতার ঘোষক, একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা, একজন সেক্টর কমান্ডার, একজন রাষ্ট্রনায়ক এবং জনমানুষের নেতা হিসেবে জিয়াউর রহমানের জীবন ছিল কর্মে, সংগ্রামে এবং স্বপ্নে পরিপূর্ণ। তাঁর নেতৃত্বের যাত্রা ছিল যেমন সাহসিকতায় ভরপুর, তেমনি ছিল বহুমাত্রিক উন্নয়ন দর্শনে সমৃদ্ধ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ, যখন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিচ্ছিন্ন, সাধারণ মানুষ দিশেহারা, সেই সংকটময় মুহূর্তে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য জাতির মনোবল জাগিয়ে তোলার আহবান। জিয়ার ঘোষণাই দেশব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলনকে সংগঠিত করে তোলে, যা স্বাধীনতার পথে বাঙালিকে এগিয়ে নেয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে স্বাধীনতার সেই ঘোষণা শুনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁর “উই রিভোল্ট” আহবানটি পাকিস্তানি সামরিক কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুতি এবং মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ততার অঙ্গীকার ছিল। এ কারণে বিশ্বজুড়ে জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটি আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক অবিচ্ছেদ্য স্মারক হিসেবে স্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে অসামান্য ভূমিকা রাখেন।
বাকশালের একদলীয় শাসন ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে জনগণ গণতন্ত্র প্রত্যাশায় ছিল। জাতি তখন রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিধ্বস্ত, অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত। ঠিক এই সময় রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর উত্থান হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন এবং তাঁর নিরপেক্ষ নেতৃত্ব, সেনাবাহিনীতে গ্রহণযোগ্যতা ও দূরদর্শী কৌশলের ফলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল। ১৯৭৮ সালের নির্বাচনে এম এ জি ওসমানিকে পরাজিত করে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দেশের রাজনৈতিক সংস্কার ও প্রশাসনিক পুনর্গঠনে হাত দেন।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে জিয়া সবচেয়ে আগে যেটি উপলব্ধি করেন, তা হলো জাতিকে আত্মনির্ভরতার পথে পরিচালিত করা। এরই ভিত্তিতে তিনি উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির লক্ষ্য অর্জনে প্রণয়ন করেন ১৯ দফা কর্মসূচি। তাঁর ঘোষিত ১৯ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে তিনি গণতন্ত্র, স্বনির্ভরতা ও উৎপাদনমুখী অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন। গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে ৬৮ হাজার গ্রামকে স্বনির্ভর ইউনিট হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস নেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি জাতীয়ভাবে স্বনির্ভরতা আন্দোলনের সূচনা করেন। কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটানোর জন্য সারাদেশে খাল খনন, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, পতিত জমিতে চাষাবাদ ও একাধিক ফসল উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি গড়ে তোলেন। এক সময়ের দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার পেছনে শহীদ জিয়ার এই দৃঢ় নেতৃত্ব অগ্রগণ্য।
জিয়াউর রহমানের উন্নয়ন দর্শনে কৃষির পাশাপাশি সমান গুরুত্ব পায় গ্রামীণ অর্থনীতি, যুব উন্নয়ন এবং শিক্ষাখাত। ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। যুব সমাজকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় গড়ে তোলা হয় যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। যুবদের জন্য আত্মকর্মসংস্থানের দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি করে তিনি বেকারত্ব দূর করার পথ দেখান। নারীদের ক্ষমতায়নেও তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। নারীদের অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত করা এবং গার্মেন্টস শিল্পের বিস্তারে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে নারীদের সমাজে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করেন। তাঁর সময়েই দেশের প্রথম নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত হয়, যার ফলশ্রুতিতে নারীরা জনজীবনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং তরুণ প্রজন্মকে কাজমুখী করে গড়ে তোলার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালান। তাঁর নেতৃত্বে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সূচনা হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি গঠনে সহায়ক হয়।
শিক্ষাখাতে শহীদ জিয়ার অবদান ছিল বিশাল। তিনি বুঝেছিলেন যে একটি জাতিকে উন্নত করতে হলে স্বাক্ষরতার হার বাড়াতে হবে। তাই তিনি “গণস্বাক্ষরতা অভিযান” চালু করেন, যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান করা হয়। ১৯৮০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই গণস্বাক্ষরতা অভিযান ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি ভাষা আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে শিক্ষার গণতান্ত্রিকীকরণকে সংযুক্ত করেন। তিনি চেয়েছিলেন ১৯৮৫ সালের মধ্যে দেশের ৮০% মানুষকে সাক্ষরজ্ঞান দিতে, যা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত।
জিয়াউর রহমান শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নেই মনোযোগ দেননি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। তিনি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে আত্মনির্ভর ও সম্মানজনক একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) গঠনের প্রস্তাব তাঁরই উদ্যোগে গৃহীত হয়। ১৯৮০ সালে তিনি সার্কের প্রয়োজনীয়তা ও কাঠামো তুলে ধরেন, যা পরবর্তীতে বাস্তব রূপ পায়। এই উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও আস্থার পরিবেশ তৈরি করে, যা আজও প্রাসঙ্গিক।
বিশ্ব রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আরও একটি গুরত্বপূর্ণ দিক ছিল মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। তিনি ওআইসি (Organization of Islamic Cooperation)-তে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন, ফিলিস্তিনের পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নেন এবং মুসলিম বিশ্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি আল-কুদস কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন, ইরাক-ইরান যুদ্ধকালে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা কুড়ান। যা তাঁর সমসাময়িক মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের প্রশ্নে সাহসিকতার পরিচয় দেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করে তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নেও সেগুলোর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করেন।
তাঁর পররাষ্ট্রনীতি ছিল স্বাধীন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং বহুমুখী। বিশ্বব্যাপী জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি তাঁর দৃঢ় অবস্থান এবং উন্নয়নশীল দেশের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠার প্রয়াস তাঁকে উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি সম্মানজনক নেতৃত্বে পরিণত করেছিল। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, নতুন বাজার সৃষ্টি এবং রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা আজও অনস্বীকার্য। তাঁর হাত ধরেই গার্মেন্টস, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্প, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে।
একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন বাস্তববাদী দার্শনিক। তিনি বলতেন, “রাজনীতি হবে উন্নয়নের জন্য, রাজনীতি হবে মানুষের কল্যাণের জন্য।” সেই লক্ষ্যেই তিনি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফেরান, বাকশালের একদলীয় শাসন কাঠামো বিলুপ্ত করেন এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়ের একটি আধুনিক রূপ দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ কেবল ভাষাভিত্তিক জাতি নয়; এটি একটি ভূগোলভিত্তিক, সংস্কৃতিভিত্তিক এবং ইতিহাসভিত্তিক জাতি, যার স্বকীয়তা বিশ্বদরবারে আলাদা করে উপস্থাপন করা জরুরি।
তাঁর মৃত্যু ছিল আকস্মিক, মর্মান্তিক এবং দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর ধাক্কা। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যদের চক্রান্তে শহীদ হন জিয়াউর রহমান। একটি অসমাপ্ত অধ্যায়, একটি প্রক্রিয়াধীন স্বপ্ন হঠাৎ থেমে যায়। ইতিহাস আজও তাঁকে একজন সাহসী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মনে রাখে। প্রতিনিয়ত নতুন প্রজন্মের কাছে জিয়াউর রহমান হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার প্রতীক। তাঁর সততা, কর্মনিষ্ঠা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা আজও রাষ্ট্র পরিচালনায় আদর্শ হয়ে আছে। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে আত্মনির্ভর ও মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে।
আজ, তাঁর ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা কেবল একজন রাষ্ট্রপতিকে নয়, একজন সৎ দেশ গঠনের কারিগরকে স্মরণ করছি, যাঁর হাত ধরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ একটি আত্মবিশ্বাসী জাতিতে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল। শহীদ জিয়ার অসমাপ্ত অধ্যায় আমাদের চেতনাকে তাড়িত করে, আমাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় তাঁর সেই অমোঘ বাক্য “আমরা সবাই একসাথে কাজ করব, এই দেশকে সত্যিকার অর্থে গড়ে তুলব একটি উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশ হিসেবে।
শেখ রিফাদ মাহমুদ
চেয়ারম্যান, এসআরআই ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন
এডুকেশন রিলেশন অফিসার, কমনওয়েলথ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন