রমজানে মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি ও তেলওয়াত


Nazmus Sakib প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৮, ২০২৩, ১০:০১ পূর্বাহ্ণ /
রমজানে মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি ও তেলওয়াত
রমজানে মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি ও তেলওয়াত
সাইমুম আল মাহদী
সারাবিশ্বে চলছে রমজানের আমেজ। সারাবিশ্বের মুসলমান রয়েছে সিয়াম সাধনাতে ব্যস্ত। এরই মাঝে বাংলাদেশের একজন শাইখ রমজানে মুসল্লীদের ডাকাডাকির বিষয় নিয়ে ব্যপক আপত্তি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন “ভোর রাতে সাহরির সময় মসজিদের মাইকে অতিরিক্ত ডাকাডাকি এবং গজল গাওয়ার প্রথা বন্ধ হওয়া উচিত।” এই মাসয়ালাতে, শায়েখদের সাথে পুরোপুরি একমত হতে পারলাম না, যারা এটাকে বর্জনীয় ও অপছন্দনীয় বলেছেন। হ্যাঁ তবে অতিরিক্ত জিনিসটাই বর্জনীয়। কিন্তু ডাকাডাকি কিংবা রমাজানে তেলওয়াত, নাশিদের সাংস্কৃতি সম্পূর্ণ রূপে যদি বিরক্তির রোষানলে পরে হারিয়ে যায়, তাহলে জেনে রাখুন, ধর্মীয় সাংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটবে। ধর্মীয় ব্যালেন্স ভেঙে পরবে।
যেমনটা মাসজিদে বাচ্চাদের নিয়ে আসা নিয়ে, বিরক্তিবোধে পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে, ধর্মচর্চার উপরে প্রভাব ফেলেছে। ছোট বেলার আদব শিক্ষার অভাবে, ইমাম সাহেবকে বর্তমান প্রজন্মে সালাম তো দূরের কথা, ইমামের সাথে গোলামের মতো আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পরেছে।

আসুন মূল টপিকে যাই।  মাইকে আহ্বান করাকে আপাতত একটা “সমস্যা” হিসেবে বিবেচনা করে, চলুন যাই, ইসলামী শরীয়াহ قواعد الفقهية এর উসূলের দিকে। এটা যেহেতু قضايا فقهية معاصرة অর্থাৎ আধুনিক মাসয়ালা সেহেতু এটার ব্যাপারে কোনো নস নেই। (মাইকে ডাকাডাকি) উলামায়ে উম্মাহের ঐক্যমতের কাওয়েদুল ফিকহে الضرر يزال এর আওতাধীন শাখা قواعد হল,  يتحمل الضرر الخاص لأجل دفع الضرر العام সহজ বাংলায়, বড় একটা জনগোষ্ঠীকে বড় ক্ষতি থেকে বাচাতে গিয়ে, ছোট ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার বৈধতা রয়েছে।

আরো সহজ ভাবে বললে, ধরুন, যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ অবস্থায় মুসলমানদের দিকে ১০০০ কাফের তেড়ে আসতেছে। এদিকে মুসলিম জাইশদের হাতে মিনজানিক(রকেট লান্সার) আছে। আঘাত করলেই ধেয়ে আসা সব কাফের মারা পরবে। কিন্তু সমস্যা হল, কাফেরদের মাঝে ৫০ জন মুসলমান সৈনিক যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। যদি মিনজানিক নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে সেই মুসলিম সৈন্যরাও তাদের সাথে মারা পরবে। এখন কি ৫০ জন কে বাঁচাতে গিয়ে ১০০০ কাফেরকে ছেড়ে দিবেন? যারা ধেয়ে এসে ৫০০ মুসলমানকে শহীদ করবে?

এ ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়াহ আপনাকে বৈধতা দিয়েছে যে, তাদের মাঝে মুসলমান সৈনিক থাকা সত্ত্বেও আপনি মিনজানিক নিক্ষেপ করতে পারবেন। এটাই হল, মূল কাওয়াদের বক্তব্য। আশাকরি আমার বক্তব্য বুঝতে পেরেছেন। এখন আর গুটি কয়েকজনের তাহাজ্জুদ, তেলওয়াত নিয়ে সমস্যা হবে না। ডাকাডাকির মূল উদ্দেশ্য এবং সার্বজনীন ফলাফলের দিকে তাকালে। আপনি শিক্ষিত মানুষ বলে, এলার্ম কি তা জানেন। কিন্তু গ্রামের ঐ কৃষকের কাছে ফোন থাকলেও, রিসিভ আর ডায়েল ছাড়া কিছুই জানে না।

মাইকে না ঢাকা হলে, হতে পারে অনেক মানুষ ঘুম থেকে উঠতে পারবে না। রোজাও হয়তো রাখবে না। রোযা ফরজ ইবাদত কিন্তু আপনার তাহাজ্জুদ, তেলওয়াত কিন্তু ফরজ ইবাদত নয়। রোজা না রাখতে পারার কারণ হল, সাহরী খেতে পারেনি। তার তো দিনে সূর্যের প্রচন্ড তাপে রক্ত পানি করে উপার্জন করতে হয়।  আমি গ্রামের সাধারণ মানুষের উদাহরণ টেনেছি। কারণ আমার ১৮ কোটি জনগণের ৭০% মানুষই খেটে খাওয়া স্বাধারণ জনগন। আপনার/আমার মতো এসি রুমে বসে, রোজার দিন পার করে না।

এবার আমাকে বলুন, আপনার তাহাজ্জুদে বিঘ্ন ঘটে, কিংবা তেলওয়াত অথবা ঘুমে, এ জন্য এতবড় জনগোষ্ঠীর মাসলাহার কথা ভাববেন না? মাসজিদের মাইকে যা কিছু প্রচার হচ্ছে, এটা তো ইসলামী সাংস্কৃতিরই জানান দিচ্ছে। হয়তো আপনার ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে, কিংবা বাচ্চাদের ঘুমাতে কষ্ট হয়, এটা তো সাময়িক সময়ের ক্ষতি। কিন্তু জেনে রাখুন, এর দ্বারা একটা জাতির মাইন্ড সেট হচ্ছে। ধর্মের বাণী কানে কানে পৌছে যাচ্ছে। মন উৎফুল্ল হচ্ছে। মনে একটা ভালো লাগা কাজ করে। কে জানে, এই আহবান শুনে, গুনাহ করতে থাকা কেউ একজন গুনাহ ছেড়ে দিচ্ছে। কিংবা আবেগ আপ্লুত হয়ে মাসজিদ পানে ছুটছে!

আমাকে বলুন তো রমজান ছাড়া কে কুরআন একটু ছুয়ে দেখে? নিজ উদ্যোগে ফোন থেকে তেলওয়াত ডাউনলোড করে শুনে? এই সংখ্যাটা কত শতাংশ আমাকে বলতে পারবেন? কিন্তু মাইকে তেলওয়াত হচ্ছে, ইচ্ছায় অনিচ্ছায় মানুষ শুনছে। আরে রমজান তো আসছে, কুরআনের জন্য। আর আপনাদের কাছে, কিছু অজুহাতে এটা কেন যে কেন বিরক্তকর মনে হয়, আমার বুঝে আসে না।  সাহরীতে ডাকার ব্যাপারে তো কত হাদীস রয়েছে। স্বয়ং রাসূল (সা:) সাহাবাদের সাহরীর জন্য ডেকেছেন। “তোমরা বরকতময় সাহরীর দিকে আসো।”- সুনান আন নাসাঈ।

এছাড়াও  ইমাম আবু বকর ইবনু আবী শায়বাহ রহ. বর্ণনা করেছেন, ‘আবু রুহম সামাঈ হতে বর্ণিত, নিশ্চয় তিনি হযরত ইরবাদ্ব ইবনু সারিয়া রাদ্বি. কে বলতে শুনেছেন, রাসূলে পাক দঃ আমাদেরকে রমজান মাসে সাহরীর জন্য ডাকতেন এবং তিঁনি বলতেন: বরকতময় ভোররাত্র। (মুছান্নাফু ইবনু আবী শায়বাহ, হাদিস নং ৮৭২১) হযরত ইরবাদ্ব ইবনু সারিয়া রাদ্বি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে পাক দঃ আমাকে রমজান মাসে সাহরীর সময় ডেকে বললেন: বরকতময় ভোরের সাহরীর দিকে আসো।” (সুনানু আবী দাউদ, হাদিস নং ২০০০; মুসনাদু আহমাদ, হাদিস নং ১৬৮১২; মুজামুল কবীর হাদিস নং ১৫০৫০)  হযরত ইরবাদ্ব ইবনু সারিয়া রাদ্বি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলে পাক দঃ কে এক ব্যক্তিকে সাহরীর জন্য ডাকতে শুনেছি। দাওরাকী ও আব্দুল্লাহ ইবনু হাশিম বলেছেন: রাসূলে আকরাম দঃ কে বলতে শুনেছি, তিঁনি রমজান মাসে সাহরীর জন্য ডাকতেন ও বলতেন: তোমরা বরকতময় ভোরের সাহরীর দিকে আসো।” (ছহীহ্ ইবনু খুজাইমা, হাদিস নং ১৮৩৫) উপরের সব গুলো হাদিস সনদের দিক থেকে শক্তিশালী। শাইখ যেটাকে বিরক্তিকর বলছেন আমরা সেটাকে সুন্নাহ হিসাবে পেলাম।

অমুসলিম অভ্যুসিত এলাকা থেকে মাইক ঘুরিয়ে মুসলিম অভ্যুসিতদের দিকে দেওয়া।  রমজানের সারারাত ধরে তেলওয়াত, গজল কেন চলবে? সাহরীর আগ মুহুর্তগুলোতে সাংস্কৃতির অংশ হিসেবে চলতেই পারে। মিশরে দেখেছি ইফতার ও সাহরীর আগ মুহূর্তগুলো তারা এগুলো বাজিয়ে থাকেন। যাতে রমাজানের একটা আমেজ-উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরী হয়। আপনার বাসায় অসুস্থ মানুষ থাকলে জানালা বন্ধ করুন। আমার মনে হয় না যে, গড়ে সব মাসজিদের মাইকগুলো এত শক্তিশালী যে, আপনার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। তবে মাসজিদের কাছাকাছি বিশেষ কিছু জায়গাতে এমন সমস্যা হতেই পারে।  মাসজিদে মাইক বাজলে যে ইবাদত করা যায় না, এটা ভুল কথা। মাসজিদের মাইকে কি ঢোল তবলার হারাম গান বাজে, যা আপনার কর্ণকুহুরে শিহরণ তোলে? না, এমনটা হয় না।

সর্বোপরি, মিশরে দেখেছি, রমাজান মাসে প্রতিটা বাসা, প্রতিটা ওলি গলি সব কিছু রমাদানের নানান শামাদানে সুসজ্জিত করা হয়। চোখ পরতেই আপনার মনে একটা প্রশান্তি কাজ করবে। সব কিছুই এই মাসের জন্য সজ্জিত হচ্ছে। সব জায়গাতে উৎসবমুখর পরিবেশ।

মাসজিদের মাইকগুলোতে সুমধুর তেলওয়াত ভেসে আসছে। সবাই জায়গানামাজ, পাগড়ী, তজবি নিয়ে মাসজিদে ছুটছে। আতরের ঘ্রাণে সব দিক সুঘ্রাণ। এই ইনভায়রোমেন্টে একজন ফাসেকও আল্লাহর ওলিতে পরিণত হয়।

আর আপনারা ধর্মকে সংকীর্ণ করতে করতে মাসজিদে ঢুকিয়েছেন। রাস্তাঘাট থেকে দূরে তো রাখছেনই। আরো সংক্ষিপ্ত করে, এবার মোবাইলের এলার্ম পর্যন্ত নিয়ে আসছেন। অর্থাৎ ধর্মচর্চা ব্যক্তিগত ইস্যুতে পরিনত হয়েছে। কিন্তু এর দ্বারা মানুষগুলো ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছে, তার আত্ম পরিচয়। জানেই না, মাসজিদের পথ কোন দিকে! সে জানেই না যে, তার ধর্ম আচার-সাংস্কৃতির পৃথিবীতে কতটা সু মহান উচ্চতায় সমাসীন। তারও আছে, পর্বতসম সুবিশাল তাহজিব-তামাদ্দুন। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিশর।
WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com