ডুমুরিয়া (খুলনা) প্রতিনিধি
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় গত দুই মাসে টানা বৃষ্টিতে প্রায় ২৭ হেক্টর (এক-তৃতীয়াংশ) জমির শিম গাছ মারা গেছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয়ে চাষিরা। উপজেলায় শিমের বাজারকেন্দ্রিক প্রায় সাত হাজার নারী-পুরুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন।
ডুমুরিয়া সদর, খর্নিয়া, শোভনা, আটলিয়া, মাগুরাঘোনা, সাহস, ভান্ডারপাড়া, শরাফপুর, রংপুর, গুটুদিয়া, ধামালিয়া, রঘুনাথপুর, মাগুরখালী ও রুদাঘরা ইউনিয়নের ২২৬টি গ্রামে শিম আবাদ বেশি হয়। গত মৌসুমে ৭৬ হেক্টর জমিতে আবাদ করে চাষিরা ৮ হাজার ৯০০ টন শিম পান, যা বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৭০ কোটি টাকা।
চলতি মৌসুমে (আগাম) ৮০ হেক্টর জমিতে শিমের আবাদ হয়েছে। চাষিরা ৮ হাজার ৯৯২ টন শিম উৎপাদনের আশা করছেন। কিন্তু অতিবৃষ্টিতে ক্ষেত তলিয়ে এক-তৃতীয়াংশ জমির শিম গাছ মরে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৬ কোটি টাকা। তবে উঁচু জায়গা ও সরকারি বিভিন্ন সড়কের দু’পাশ ঘেঁষে স্বল্প পরিসরে কিছু শিম গাছে ব্যাপক ফুল-ফল দেখা গেছে। স্থানীয়দের ভাষ্যে, ১৫ বছর আগে ডুমুরিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে শিম চাষ শুরু হয়। গ্রামীণ সড়কের পাশে, বিল ও চিংড়ি ঘেরের আইলে, বসতভিটার আঙিনায় কঞ্চি, বেড়া, জাল বা শুকনা ডালে মৌসুমে ফুল ও শিম বাতাসে দুলতে দেখা যায়। নামমাত্র খরচের বিপরীতে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরা শিম চাষে আগ্রহী হন। ফড়িয়ারা সরাসরি ক্ষেতে এসে নগদ টাকা দিয়ে শিম কিনে নিয়ে যান।
খুলনা জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ঘেঁষে ডুমুরিয়ায় পাঁচটি কাঁচাবাজার রয়েছে। উপজেলা আঠারোমাইল, শরাফপুর, আটলিয়া, রংপুর, খর্নিয়া, রাজীবপুর, ঘোনাবান্দা, জাবড়া, উলা, বটতলা, রঘুনাথপুরেও রয়েছে বাজার। বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক ঘেঁষে ১২টি বাজার গড়ে উঠেছে। কিন্তু গত বছরের মতো এসব বাজারে এখনও শিমের কেনাবেচা জমেনি।
খর্নিয়া গ্রামের কৃষক আবু হানিফ মোড়ল খর্নিয়া বিলডাঙ্গা বিলে ৯ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করেন। জ্যৈষ্ঠ মাসে ওই ঘেরের আইলে সাড়ে ৫০০ শিমের মাচা তৈরি করে বীজ বপন করেন। গাছ লতিয়েও যায়। এরপর ১৫ দিনের মধ্যে গাছে শিম আসতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত খরচ করেছেন ৯৬ হাজার টাকা। হানিফ মোড়ল বলেন, ‘সব খরচ বাদ দিয়ে আমি সাড়ে ৭ লাখ টাকার শিম বিক্রির আশা করেছিলাম। কিন্তু টানা বৃষ্টিতে অধিকাংশ গাছ মারা গেছে। সব মিলিয়ে এবার ২ লাখ টাকার শিম বিক্রি হতে পারে।
উৎপাদন কম বলে বাজারে এখন শিমের সরবরাহ কম। বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি। গত বছর এ সময় শিমের কেজি ছিল ৩০ টাকা। ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ফড়িয়ারা সরাসরি ক্ষেতের শিম কিনতে চাচ্ছেন না। পরিবহন খরচও বহনে অনিচ্ছুক। বরাতিয়া গ্রামের কৃষক নবদ্বীপ মণ্ডল জানান, মহাসড়কের পাশ দিয়ে প্রায় ৫০টি শিম গাছ রোপণ করেছিলেন তিনি। খরচ হয়েছিল দেড় হাজার টাকা। গাছের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রায় ৬০ হাজার টাকার শিম বিক্রি করবেন আশা তাঁর।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শিমের একাধিক পাইকারি বাজারে ন্যায্যমূল্যে শিম বিক্রি করা হয়। উপজেলা সদরে ‘আল্লাহর দান’ কাঁচাবাজারের স্বত্বাধিকারী জি এম আনিচুর রহমান বলেন, প্রতিবছর এই এলাকায় শিমের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাক-পিকআপে চলে যায়। অতিবর্ষণে এবার শিমের ক্ষেত নষ্ট হওয়ায় বাজারে দাম চড়া।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহাবুব-উল ইসলাম বলেন, ডুমুরিয়া অঞ্চলে মাছের ঘেরের বেড়িবাঁধে শিম চাষ করে হাজারো কৃষকের ভাগ্য বদল হয়েছে। একই সঙ্গে বহু লোকের কর্মসংস্থানসহ এ অঞ্চলে কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়। কিন্তু এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিমের আবাদ ধসের ফলে কৃষকের ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্ষয় ঘটেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইনসাদ ইবনে-আমিন জানান, গত বছর উপজেলায় ৭০ কোটি টাকার শিম বেচা হয়। চলতি মৌসুমে গত দুই মাসের টানা বর্ষণে শিমসহ কৃষিতে বড় আঘাত পড়েছে। এতে ২৬ কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন করে বীজতলা প্রস্তুতের জন্য কৃষক ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা মাঠে নজরদারি করছেন।