সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম (আনার) কে দীর্ঘ তিনমাস আগে থেকে ঢাকায় বসে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। হত্যা করা হয় ভারতের কলকাতায়। তিনি খুন হয়েছেন বলে ঢাকা ও কলকাতার পুলিশ নিশ্চিত করলেও গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাঁর লাশ উদ্ধার হয়নি। এই ঘটনায় নতুন করে কলকাতায় একজনকে গ্রেপ্তার এবং অন্য একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।
এ ঘটনায় কলকাতার সিআইডি পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ । তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, খুনের আগে লাশ গুমের পরিকল্পনা সাজায় খুনিরা। এ জন্য তাঁরা ট্রলি ব্যাগ, চাপাতি, ব্লিচিং পাউডার, পলিথিনসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে রাখে। ১৩ মে কলকাতার নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে আনোয়ারুলকে হত্যার পর লাশ টুকরা টুকরা করে ব্যাগে ভরে বাইরে ফেলে দেয়া হয়েছে। এর কিছু অংশ কলকাতার একটি খালে ফেলা হয়েছে। কলকাতা পুলিশ খুনিদের ভাড়া ফ্ল্যাটের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এবং ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কলকাতার সিআইডি পুলিশের একটি সূত্র বলছে, নিউ টাউনের যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীমকে খুন করা হয়েছে বলে শনাক্ত করা হয়েছে, সেখানকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, কয়েক ব্যক্তি ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বেরোচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন ইতিমধ্যে ঢাকায় ধরা পড়েছেন। কলকাতা পুলিশ মনে করছে, ওই ট্রলি ব্যাগের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির খণ্ডিত দেহ সরানো হয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, লাশ গুম করার ক্ষেত্রে কলকাতায় অন্য একটি দল সহায়তা করছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ জন্য খুনের পর পুলিশ ও স্বজনদের বিভ্রান্ত করার জন্য আনোয়ারুলের ফোন থেকে নিকটজনদের খুদে বার্তা পাঠানো হয়। এই কাজে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের এখনো শনাক্ত করা যায়নি।
এদিকে গতকাল ঢাকায় মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, আনোয়ারুল আজীমকে হত্যার পর লাশ খণ্ড খণ্ড করে গুম করা হয়। তাঁর পুরো লাশ না পাওয়া গেলেও খণ্ডিত মরদেহ পাওয়া যাবে মনে করেন তিনি। ডিবিপ্রধান বলেন, খুনিরা অনেক দিন ধরে এই সংসদ সদস্যকে হত্যার সুযোগ খুঁজছিলো। এক-দুই মাস ধরে ঢাকার গুলশান ও বসুন্ধরার দুটি বাসায় এ নিয়ে পরিকল্পনা সাজানো হয়। ঢাকায় ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকায় হত্যার স্থান হিসেবে কলকাতাকে বেছে নেওয়া হয়।
আনোয়ারুল হত্যায় জড়িত সন্দেহে কলকাতা পুলিশের দেওয়া তথ্যর ভিত্তিতে সেখান থেকে দেশে ফেরা তিনজনকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাঁদের গতকাল ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। আনোয়ারুল আজীমকে অপহরণ করার অভিযোগ এনে বুধবার মামলাটি করেন তাঁর মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস।
গ্রেপ্তার তিনজন হলেন শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ, শিলাস্তি রহমান ও তানভীর ভূঁইয়া। এই তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানিয়েছিল, খুনের ঘটনায় জিহাদ ও সিয়াম নামের আরও দুজনের নাম এসেছে।
ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ জানান, সংসদ সদস্য খুনের ঘটনায় সিয়াম নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা পুলিশ।
পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি পুলিশ বলছে, আনোয়ারুল আজীমের লাশ গুম করার ক্ষেত্রে সিয়ামের ভূমিকা ছিল। তাঁকে পূর্ব কলকাতার নিউ টাউন থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়া জুবের নামের এক গাড়িচালককে আটক করেছে কলকাতা পুলিশ। আনোয়ারুল ও তাঁর খুনিরা যেসব ভাড়া গাড়িতে চড়েছেন, তার একটির চালক জুবের। তাঁকেও নিউ টাউন থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রাজ্য পুলিশ সূত্র বলছে, জুবের ভারতের নাগরিক। অন্যদিকে সিয়াম বাংলাদেশের নাগরিক বলে জানিয়েছে কলকাতার সিআইডি পুলিশ।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, কয়েক ব্যক্তি ট্রলি ব্যাগ নিয়ে বেরোচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন ইতিমধ্যে ঢাকায় ধরা পড়েছেন। কলকাতা পুলিশ মনে করছে, ওই ট্রলি ব্যাগের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির খণ্ডিত দেহ সরানো হয়েছে।
আনোয়ারুল হত্যার তদন্তে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও বাংলাদেশের পুলিশ সমন্বয় করে তদন্ত করছে। তদন্তকাজে বাংলাদেশ পুলিশের একটি দল কলকাতায় যাওয়ার আলাপ-আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) চার সদস্যের একটি দল গতকাল বাংলাদেশে এসেছে। তাঁরা গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। রাত ১০টার দিকে তাঁরা ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যান।
ডিবির ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. শাহিদুর রহমানের কক্ষে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য খুনের রহস্য উন্মোচনে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে আমরা তথ্য বিনিময় করছি। তদন্তে তাঁরা এ পর্যন্ত যেসব তথ্য পেয়েছেন, সেগুলো নিয়ে আটক তিনজনের কাছে জানতে চেয়েছেন। আমরাও তাঁদের তদন্তে পাওয়া বিষয়গুলো সম্পর্কে জানছি।’
আনোয়ারুল হত্যার ঘটনায় ঢাকায় যে তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তাঁদের একজনের নাম সৈয়দ আমানুল্লাহ। তাঁর পাসপোর্টে এই নামই লেখা ছিল। পুলিশ বলছে, এই খুনের জন্য তাঁকে ভাড়া করা হয়েছিল।
পরে জানা গেছে, আমানুল্লাহর প্রকৃত নাম শিমুল ভূঁইয়া। তিনি খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী, এক সময়কার চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) অন্যতম শীর্ষ নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে খুনসহ ২৫টির মতো মামলা আছে।
ঢাকায় ধরা পড়ার পর পুলিশের কাছে শিমুল ভূঁইয়া নিজেকে সৈয়দ আমানুল্লাহ নামেই পরিচয় দেন। আমানুল্লাহ নামে করা পাসপোর্টে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পাসপোর্টটি করা হয়েছিল।
এ ছাড়া ফয়সাল আলী ওরফে সাজী নামে একজনের এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তার হয়েছেন তানভীর ভূঁইয়া। তানভীর হলেন শিমুল ভূঁইয়ার বড় ভাই লাকী ভূঁইয়ার ছেলে। শিলাস্তি রহমান নামে যে নারী গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। তিনি আক্তারুজ্জামানের বান্ধবী।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, আনোয়ারুলকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী তাঁর একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের আক্তারুজ্জামান। তিনি আরেক চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) শীর্ষ নেতা ডা. মিজানুর রহমান ওরফে টুটুলের আত্মীয়।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ১২ মে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান। আট দিন নিখোঁজ থাকার পর গত বুধবার তাঁর খুন হওয়ার বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত করে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আনোয়ারুল আজীমকে যারা হত্যা করেছে, তাদের চিহ্নিত করার প্রায় কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। শুধু ঘোষণার বাকি। ঘোষণাটি দেওয়া হবে দুই দেশের গোয়েন্দারা সম্পূর্ণ একমত হতে পারলে।’