
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র শহীদ আবরার ফাহাদ— যার আত্মত্যাগ বাংলাদেশের ছাত্রসমাজে জাগিয়ে তুলেছিল নতুন চেতনা ও প্রতিবাদের আগুন— সেই চেতনারই প্রতীক হয়ে ঢাকার ঐতিহাসিক পলাশী মোড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে ‘আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) উদ্যোগে নির্মিত এই স্থাপনাটি শুধু একটি স্থাপত্য নয়; এটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের অবিচল অবস্থান, সার্বভৌমতার প্রতীক এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক সংগ্রামের অঙ্গীকার।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরে বাংলা হলে আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ড গোটা জাতিকে স্তব্ধ করেছিল। সেই ঘটনার পাঁচ বছর পর, তার আদর্শ ও স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গড়ে উঠেছে এই স্মৃতিস্তম্ভ— ‘শহীদ আবরার ফাহাদ স্মৃতি স্মরণে আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ’।
স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা আছে আবরারের অমর উক্তি: “অনন্ত মহাকালে মোর যাত্রা, অসীম মহাকাশের অন্তে।”
এই অনন্ত যাত্রার প্রতীক আটটি স্তম্ভে প্রকাশ পেয়েছে আটটি মৌলিক নীতি— সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, জনগণের প্রতিরক্ষা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, স্থানীয় শিল্পরক্ষা, কৃষি–নদী–বন–বন্দর সংরক্ষণ, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও মানব মর্যাদা।
প্রথম দিকে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ বারবার বাধাগ্রস্ত হলেও ছাত্র অধিকার সংগঠন ও আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলেই অবশেষে বাস্তব রূপ পায় এই স্থাপনা। ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর প্রথম নির্মিত স্তম্ভটি ভেঙে ফেলা হলেও আদর্শকে কেউ মুছে দিতে পারেনি— বরং সেই প্রতিবাদই আজ এক চিরস্থায়ী স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডিএসসিসির তথ্যমতে, প্রকল্পের মোট ব্যয় ৮৪.৭৫ লাখ টাকা, যার মধ্যে শুধুমাত্র স্তম্ভ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৯.৫৯ লাখ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্বপন ট্রেডিং কর্পোরেশন আগস্টে কাজ শুরু করে এবং ৫ অক্টোবরের মধ্যে শতভাগ ভৌত অগ্রগতি সম্পন্ন হয়।
৩৭৮.৭২ বর্গফুট এলাকায় স্থাপিত এই স্থাপনাটিতে ব্যবহৃত হয়েছে ১,০১৮.২৪ বর্গফুট গ্রানাইট স্টোন, ৫৬৬.৮৫ বর্গফুট এম.এস. প্লেট এবং আধুনিক সিএনসি কাটিং প্রযুক্তি। রাতে দীপ্ত আলোয় ঝলমল করে ওঠে স্তম্ভগুলো— প্রতিটি স্তম্ভের নিচে স্থাপন করা হয়েছে প্রজেকশন ও গ্রাউন্ড লাইট, যা যেন ঢাকার আকাশে আবরারের চেতনার শিখা প্রজ্বলিত রাখে।
বুয়েটের ছাত্র আব্দুল্লাহ বলেন, যখনই পলাশীর মোড় দিয়ে যাই, এই স্তম্ভগুলো মনে করিয়ে দেয়— জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্ব ও মানব মর্যাদা রক্ষায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করাটাই প্রকৃত দায়িত্ব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা নাদিম মাহমুদ বলেন, এই স্থাপনাটি শুধু স্মৃতি নয়, এটি জাতীয় মুক্তির বীজমন্ত্র। আবরারের স্বপ্ন ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো— আমরা এখন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে।
শহীদ আবরারের ভাই আবরার ফাইয়াজ বলেন, আমাদের সমাজে রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা দূর করে ন্যায়ের সমাজ গঠনের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। আবরার নদী ও দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে শহীদ হয়েছিলেন— সেই প্রতিশ্রুতিই আমাদের ধরে রাখতে হবে।
আবরার ফাহাদ স্মৃতি সংসদের আহ্বায়ক আখতার হোসেন বলেন, ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আবরারের প্রতিবাদের চেতনাকে কেন্দ্র করেই আমরা এই স্থাপনাটির নাম দিয়েছি ‘আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ’। এই আটটি নীতি বাস্তবায়িত হলে একটি আগ্রাসনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।
ডিএসসিসির অঞ্চল ১–এর প্রধান নির্বাহী আবু সালেহ মুসতানজির বলেন, আবরার ফাহাদ কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি এক চেতনা ও আদর্শ। সেই চেতনাকেই ধারণ করেই এই স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছে।
পাশাপাশি পলাশী ইন্টারসেকশন উন্নয়ন প্রকল্পও দ্রুত এগিয়ে চলছে, যা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্পন্ন হওয়ার কথা। রাস্তা, ড্রেনেজ ও আলোকসজ্জার উন্নয়নে পুরো এলাকাটি পাচ্ছে নতুন রূপ।
পলাশী মোড়ের ‘আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ’ আজ কেবল আবরারের স্মরণ নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অঙ্গীকার— যে কোনো আগ্রাসনের মুখেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মানব মর্যাদা ও ন্যায়ের চেতনা থাকবে অম্লান।
আবরার ফাহাদ আজ আর কেবল একটি নাম নন; তিনি এক চেতনার স্থপতি, যিনি অনন্ত মহাকালে যাত্রা শুরু করে গেছেন— অসীমের পথে।