ইয়েমেন-ইসরায়েল সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। বহু দশক ধরে এ অঞ্চলে যুদ্ধ ও সংঘাত চলমান থাকায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে সন্ত্রাসী ইসরায়েলের আগ্রাসন ঘিরে। আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ, জাতিসংঘের প্রস্তাব উপেক্ষা এবং নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর ধারাবাহিক গণহত্যা চালিয়ে রাষ্ট্রটিকে আজ বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজার ওপর ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে হাসপাতাল, বিদ্যালয়, ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে পড়ছে ধ্বংসস্তূপে, আর রক্তাক্ত শিশু ও নিরীহ মানুষের লাশ হয়ে উঠছে বিশ্ব বিবেকের সামনে নৃশংসতার সাক্ষী। এই প্রেক্ষাপটেই ইয়েমেনের হুতিরা ঘোষণা দিয়েছে যে তারা গাজার পাশে থাকবে, আর সেই ঘোষণা এখন কেবলমাত্র মানবিক সহমর্মিতা নয়, বরং ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক শক্ত প্রতিরোধ ফ্রন্ট গড়ে উঠছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইয়েমেনের হুতি-সমর্থিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী নিহত হওয়ার পর হুতিদের প্রতিরোধ আরও তীব্র আকার নিয়েছে। তারা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, আক্রমণাত্মক ড্রোন ও সমুদ্রপথে অভিযান চালিয়ে ইসরায়েলের ভেতরে গভীর আঘাত হানছে। এমনকি তাদের হাতে এখন “প্যালেস্টাইন-২” নামের নতুন ধরনের ক্লাস্টার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা ইসরায়েলের ভেতরে কিংবা রেড সি অঞ্চলে আরও হামলার পূর্বাভাস দিচ্ছে। এর ফলে হুতিদের প্রতিরোধ এখন কৌশলগত সামরিক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। যদিও ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালাচ্ছে, কিন্তু হুতিদের প্রযুক্তি ঠেকাতে গিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা আরোও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ইয়েমেন থেকে পাঠানো একটি ড্রোন ইসরায়েলের নেগেভ অঞ্চলের রামোন বিমানবন্দরে বিস্ফোরিত হয়।
ইসরায়েলকে কেন একটি আগাগোড়া সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বলা হয়, তার উত্তর পাওয়া যায় তাদের কর্মকাণ্ডে। ফিলিস্তিনের মাটিতে তারা প্রতিদিন শিশু হত্যা করছে, নারী নির্যাতন করছে এবং অবকাঠামো লক্ষ্য করে নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জাতিসংঘের প্রস্তাব উপেক্ষা করে তারা দখলদারিত্ব এবং উপনিবেশ স্থাপন করা অব্যাহত রেখেছে। ইসরায়েল পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র রাষ্ট্র, যা টিকে থাকার জন্য গণহত্যাকে রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত করেছে। এবং প্রতিদিন তা বাস্তবায়ন করে চলছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইয়েমেন-ইসরায়েল সংঘাত পুরোপুরি আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নেবে না। বিশ্লেষক কামাল জাগলুল মনে করেন, হুতিদের প্রতিরোধ সীমিত পর্যায়ে থাকবে যাতে আন্তর্জাতিক জোট ইসরায়েলের পক্ষে না যায়। অন্যদিকে আহমেদ আল-ইয়াসিরির মতে, হুতিদের সাফল্য ইসরায়েলকে সরাসরি ইরানকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে, যা নতুন যুদ্ধ ফ্রন্ট খুলবে। হাজেম আয়াদের মতে, হুতিদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপও সংঘাতকে বিস্তৃত করার ঝুঁকি বহন করছে।
এদিকে রেড সি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ, যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি ডলারের তেল ও পণ্য পরিবাহিত হয়। হুতিদের হামলা যদি এ অঞ্চলে বেড়ে যায়, তবে বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ধাক্কা খাবে, এমনকি সংঘাত সীমিত থাকলেও তার প্রভাব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
সব মিলিয়ে ইয়েমেন-ইসরায়েল সংঘাত এখন আর কেবল একটি আঞ্চলিক সংঘাত নয়, বরং সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হুতিদের নতুন সামরিক কৌশল, ইসরায়েলের দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়া এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির টানাপোড়েন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আগামী দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য আরও অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায় গাজার ওপর চলমান গণহত্যা বন্ধে বিশ্ব কতটা আন্তরিক হবে? আর যদি আন্তর্জাতিক মহল নীরব থাকে, তবে হুতিদের মতো প্রতিরোধ ফ্রন্ট কি আরও প্রয়োজন নয় কি? গণহত্যা আর কত?
📌 তথ্যসূত্র: শাফাক নিউজ, আল জাজিরা