ইসলামী জ্ঞানের বাতিঘর ড. আহমেদ ওমর হাসেম কে ছিলেন?

বাংলাদেশ চিত্র ডেস্ক

আফছার হোসাইন (মিশর থেকে)
ইসলামী বিশ্বের মহাপুরুষ, বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ এক লক্ষ হাদিসের হাফেজ, বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও মিশরের সিনিয়র আলেম পরিষদের সম্মানিত সদস্য অধ্যাপক ড. আহমেদ ওমর হাসেম (৪৮) বার্ধক্য জনিত কারনে আজ মঙ্গলবার (৭ই অক্টোবর) সকালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

তাঁর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে গভীর শোক ও আবেগঘন বার্তায় মৃত্যুসংবাদটি জানানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে— “আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণ নিয়ে আমরা আরব ও ইসলামি বিশ্ব, প্রিয়জন ও শিক্ষার্থীদের জানাচ্ছি যে, আমাদের প্রিয়, শ্রদ্ধেয় ইমাম ড. আহমেদ ওমর হাসেমের ইন্তেকালের  ইন্তেকাল করেছেন। আমরা মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছি—তিনি যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন, তাঁর পরিবারকে ধৈর্য ও প্রতিদান দান করেন।” আজ মঙ্গলবার জোহরের নামাজের পর আল-আজহার মসজিদে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর আসরের নামাজের পর শরকিয়া প্রদেশের জাগাজিগ সেন্টারের বানী আমের গ্রামের হাশেমি স্কয়ারে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে। একই গ্রামে আজ শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে এবং বৃহস্পতিবার কায়রোতেও আনুষ্ঠানিকভাবে শোক সভার আয়োজন করা হবে।

জীবনী ও কর্মজীবন, ড. আহমেদ ওমর হাসেম ১৯৪১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬১ সালে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উসুল আদ-দ্বীন অনুষদ থেকে স্নাতক এবং ১৯৬৭ সালে ‘আল-আলমিয়্যা’ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে একই অনুষদের হাদিস বিভাগে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

১৯৬৯ সালে হাদিস বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পরবর্তীতে একই বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি হাদিস বিজ্ঞানে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৭ সালে জাগাজিগে উসুল আদ-দ্বীন অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৯৫ সালে তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি একাধারে শিক্ষক, গবেষক ও প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি মিশরের জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন, যিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া, তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনৈতিক ব্যুরো ও শুরা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি মিশরীয় রেডিও ও টেলিভিশন ইউনিয়নের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য, টেলিভিশনের ধর্মীয় কর্মসূচি কমিটির চেয়ারম্যান এবং আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও এর হাদিস বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

ইসলামী চিন্তাধারার বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— “আস-সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ ও উলূমুহা”, “উসুল আল-হাদিস”, “মিসর ও আল-আজহারের মুহাদ্দিসগণ”, “আল-আজমা আল-খলিজিয়্যাহ ফি মিজান আল-ইসলাম”, “দিফা’ আন আস-সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ”, “আল-ইসরা ওয়াল-মিরাজ”, “আন-নিসা ফি আল-ইসলাম”, “রমাদান ওয়াস-সিয়াম” প্রভৃতি। তাঁর এসব রচনা ইসলামী গবেষণার ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ ও প্রামাণ্য।

ড. হাসেম দেশ-বিদেশে অসংখ্য বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। তিনি হাদিস, সীরাহ, ইসলামী চিকিৎসা ও পবিত্র দুই মসজিদের মর্যাদা সম্পর্কিত নানা গবেষণা উপস্থাপন করেছেন।

তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের হজ মিশনের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং পাকিস্তান, আলজেরিয়া, মরক্কো, জার্মানি, কুয়েত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মিশরকে প্রতিনিধিত্ব করেন।

তিনি ১৯৯২ সালে ‘রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পুরস্কার’ এবং ‘প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞান ও কলা পদক’ অর্জন করেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে দুই শতাধিক মাস্টার্স ও পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। তিনি দেশি-বিদেশি একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আল-আজহারের সিনিয়র আলেম পরিষদের সদস্য হিসেবে ড. আহমেদ ওমর হাসেম ছিলেন আধুনিক যুগের এক প্রভাবশালী ইসলামী চিন্তাবিদ ও প্রাজ্ঞ আলেম। তাঁর মৃত্যুতে ইসলামি বিশ্ব হারালো এক জ্ঞানের বাতিঘর, ধর্মীয় প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিকতার এক উজ্জ্বল প্রতীককে।



ভালো সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ ফিডটি অনুসরণ করুন


Google News

Share This Article