অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার একটি অফিসিয়াল চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। চিঠিটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে লেখা। চিঠিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মন্ত্রণালয়টির অধীনস্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগের জন্য একজনের নাম প্রস্তাব করেছেন। বিষয়টিকে অনেকেই সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখছেন। তবে এর বিপরীত অবস্থানেও রয়েছেন কেউ কেউ। তাদের বক্তব্য, এক্ষেত্রে উপদেষ্টা কোনও নিয়ম ভঙ্গ করেননি। তিনি প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।
জানা গেছে, গত ২৩ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে ‘প্রিয় সিনিয়র সচিব’ সম্বোধন করে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার নিজের প্যাডে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রশাসক হিসেবে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন।
চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, “মোহাম্মদ এজাজ একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা। কর্মজীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হলে এই প্রতিষ্ঠানের কাজের গতি বৃদ্ধিসহ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি উজ্বল হবে বলে আমি মনে করি।”
বিষয়টিকে অনেকেই সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিঠিটি ভাইরাল হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, রাজনৈতিক সরকারের আমলে এসব হতো। মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী বা এমপিরা এভাবে আধা সরকারি চিঠি (ডিও লেটার) দিয়ে নিজেদের লোককে ক্ষমতায় বসাতো। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও অতীতের রাজনৈতিক সরকারের আমলের মতোই নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে ডিও দিয়ে ক্ষমতায় বসাচ্ছেন। যদি বিষয়টি এমন হয় তাহলে অতীতের তুলনায় বর্তমানের পার্থক্যটা কোথায়? এত আন্দোলনের পরে পরিবর্তনটা হলো কোথায়?
তবে অনেকেই বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের মতে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে এই চিঠি লিখে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ নিয়মের ব্যত্যয় করেননি। বিদ্যমান আইন ও অধ্যাদেশে কোনও কারণে সিটি করপোরেশনের জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন হলে বিদ্যমান স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ২৫ক অনুযায়ী সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। একইভাবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ আইনের কিছু সংশোধনী এনে ১৩ আগস্ট প্রজ্ঞাপন জারি করেছে যা ২০২৪ সনের ৪ নং অধ্যাদেশ। সেখানেও প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। তবে প্রশাসকের যোগ্যতা সম্পর্কে কিছুই আইন বা অধ্যাদেশে কিছুই উল্লেখ না থাকায় উপদেষ্টা তার প্রস্তাবিত ব্যক্তি সম্পর্কে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বা কর্মজীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন বলে লিখেছেন। এটি খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়ক। এতে কোনও নিয়মের ভঙ্গ হয়নি বলেও জানিয়েছেন তারা।
তারা বলেছেন, অধীনস্ত একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য যে যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা প্রয়োজন সে সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই উপদেষ্টা তার লেখা চিঠিতে উল্লেখ করে জনপ্রশাসন সচিবকে অবহিত করেছেন। যার প্রমাণ বা ডকুমেন্টস উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে রয়েছে।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এ বলা হয়েছে, ২৫ক অনুযায়ী বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রশাসক নিয়োগে ও কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা (১) এই আইনের অন্যান্য বিধানে কিংবা আপাতত বলবৎ অন্য কোনও আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার, বিশেষ পরিস্থিতিতে, অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে বা জনস্বার্থে, যে কোনও সিটি করপোরেশনে এটির কার্যাবলী সম্পাদনের উদ্দেশ্যে, একজন উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত উপযুক্ত কর্মকর্তাকে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে। (২) সরকার, প্রয়োজনবোধে, যথাযথ বলে বিবেচিত হয় এমন সংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে গঠিত কমিটিকে প্রশাসকের কর্মসম্পাদনে সহায়তা দিতে নিয়োগ করিতে পারিবে। (৩) উপ-ধারা (১) অনুযায়ী নিযুক্ত প্রশাসক এবং উপ-ধারা (২) অনুযায়ী নিযুক্ত কমিটির সদস্যরা, যদি থাকে, যথাক্রমে, মেয়র ও কাউন্সিলরের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, এই চিঠির মাধ্যমে প্রমাণিত হলো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের অতীতের রেওয়াজের সঙ্গে বর্তমান সরকারের কোনও পার্থক্য নাই। অতীতেও এমন হতো। এখনও এমনই হচ্ছে। এখানে পরিবর্তনটা কোথায়? তিনি আরও বলেছেন, উপদেষ্টা মহোদয় তার পছন্দের ব্যক্তিটিকে নিয়োগের বিষয়টি জনপ্রশাসন সচিবকে টেলিফোনে বা সাক্ষাতে বলতে পারতেন। অথবা স্থানীয় সরকার সচিব জনপ্রশাসন সচিবকে এই চিঠিটি লিখতে পারতেন। অথবা স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করতে পারতেন। এটি করলে আমরা একটা পরিবর্তন বা পার্থক্য দেখতে পেতাম। তা না করে তিনি অতীতের সরকারগুলোর মতোই চিঠি লিখলেন। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হলো ২০২৪-এর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ যে পরিবর্তনটা চেয়েছিল আসলে তেমন পরিবর্তন হয়নি।
তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, উপদেষ্টা মহোদয় প্রচলিত নিয়মেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর চিঠি লিখেছেন। এখানে বিদ্যমান আইন বা অধ্যাদেশের কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি। কারণ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তার দায়িত্বে থাকা মন্ত্রণালয়েরই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। আইন অনুযায়ী তিনি যে কাউকেই নিয়োগের বিষয়ে সচিবকে লিখতে পারেন। তবে আইনে উল্লেখ না থাকলেও তিনি তার প্রস্তাবিত কর্মকর্তার দক্ষতা-অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা সম্পর্কে অবিহিত হয়েই এই চিঠি লিখেছেন তা তিনি প্রমাণ করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, প্রশাসক হিসেবে প্রস্তাবিত কর্মকর্তার দক্ষতা অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার দলিল নিশ্চয়ই উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের ইন্টারনাল বিষয়, মন্ত্রণালয় অফিসিয়ালি আমাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না জানাবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমার কোনও বক্তব্য নেই, আমি কিছু জানি না। এই চিঠি সত্যি কিনা আমি কীভবো বলবো?
মোহাম্মদ এজাজ আরও বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়টি মিথ্যা। আর উপদেষ্টা অনেক সৎ মানুষ। তাছাড়া আমার নুন আনতে পান্না ফুরায় অবস্থা। এত টাকা পয়সার চিন্তাও করি না কখনও।’
উল্লেখ্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করা হয়েছে। তাদের অপসারণের পর সব সিটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত দুটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। অপসারণের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর ধারা ১৩ক প্রয়োগ করে বাংলাদেশের এসব সিটি করপোরেশনের মেয়রদেরকে স্ব স্ব পদ থেকে অপসারণ করা হলো। দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনে প্রশাসক করা হয়।