কেউ কেউ সাম্রাজ্য গড়েন, কেউ কেউ গড়েন সেতু। আর খুব অল্প কিছু মানুষ — যেমন কামরুল হাসান শায়ক — গড়েন দুটোই, তবে ইট-পাথর দিয়ে নয়, বই, স্বপ্ন আর অদম্য সংকল্প দিয়ে। আজ তাঁর ৬০তম জন্মদিন। আজকের দিনে আমরা শুধু জন্মদিন উদযাপন করছি না, আমরা উদযাপন করছি এক জীবনের সেই অধ্যায়, যা বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পকে দিয়েছে আধুনিকতা, আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং একটি সুদৃঢ় কাঠামো। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, নীলফামারীর সৈয়দপুরে জন্ম নেওয়া কামরুল হাসান শায়কের শেকড় চাঁদপুরে হলেও, তাঁর চিন্তা, চেতনা ও কর্ম আজ ছড়িয়ে রয়েছে দেশজুড়ে, এমনকি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। ১৯৯৩ সালে যখন দেশের প্রকাশনা শিল্প ধীরে চলা এক ট্র্যাডিশনাল যানে রূপান্তরিত, তখনই তিনি সাহসী সিদ্ধান্ত নেন—প্রযুক্তিনির্ভর, মানসম্পন্ন, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের বই তৈরি করতে হবে। তিনি শুধু স্বপ্ন দেখেননি, তা বাস্তবায়নের জন্য গড়েছেন প্রতিষ্ঠান, কাঠামো, দক্ষ জনবল। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের নেতৃত্বে থেকে তিনি বাংলাদেশে বই প্রকাশনার নতুন যুগের সূচনা করেন। তাঁর হাত ধরেই বই মুদ্রণ, সম্পাদনা, ডিজাইন, প্রি-প্রেস, মার্কেটিং—সব কিছুতে আসে কাঙ্ক্ষিত আধুনিকতা। বাংলাদেশকে তিনি তুলে ধরেছেন আন্তর্জাতিক বইমেলায়—ফ্র্যাঙ্কফুর্ট, লন্ডন, কলকাতার মেলাগুলোতে যখন বাংলাদেশ অংশ নেয়, তখন তার পেছনে থাকে তাঁর কৌশলী নেতৃত্ব। তিনি ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশের IPA-তে পূর্ণ সদস্যপদ অর্জনে, এবং APPA-এর ওয়ার্কিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সেই জায়গায় দেশের নাম প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর কার্যনির্বাহী ভূমিকা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা সংগঠনে ছিল—বাংলাদেশ বুক পাবলিশার্স অ্যান্ড সেলার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সহ-সভাপতি, অ্যাকাডেমিক অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক, PBS Ltd.-এর পরিচালক। তিনি ছিলেন বারোটোপা প্রিন্টার্স লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান, দুরসুন পাবলিকেশন্স, অক্ষরপত্র প্রকাশনী, Words and Pages-এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। তিনি শুধু প্রকাশনা নিয়ে কাজ করেননি, লিখেছেন নিজেও। শিশু-কিশোর সাহিত্যে তাঁর দুটি বই—‘জেমি ও জাদুর শিমগাছ’ ও ‘মৎস্যকুমারী ও এক আশ্চর্য নগরী’—পাঠকের প্রিয়তা পেয়েছে। পাশাপাশি তিনি প্রকাশনা পেশার জন্য একাধিক গাইডবুক রচনা করেছেন—‘মুদ্রণশৈলী ও নান্দনিক প্রকাশনার নির্দেশিকা’, ‘পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতকরণ, সম্পাদনা ও প্রুফরিডিং’, ‘পুস্তক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা’—যা আজ পেশাজীবীদের কাছে রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কামরুল হাসান শায়ক শুধু প্রকাশনার সংগঠক বা লেখক নন, তিনি একজন সংস্কৃতিচিন্তক ও সমাজসেবকও। তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সদস্য, SAARC চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, জাতিসংঘ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, FBCCI এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সক্রিয় সদস্য। তাঁর এই ছয় দশকের যাত্রা কেবল একজন মানুষের অর্জনের ইতিহাস নয়, এটি বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অগ্রযাত্রার ইতিহাস। কামরুল হাসান শায়ক নিজেকে কখনোই সামনে আনেননি, বরং বই, লেখক ও প্রকাশনাকে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন—শব্দই শক্তি, জ্ঞানই অগ্রগতি। আজ তাঁর ৬০তম জন্মদিনে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রদ্ধা জানাই এমন একজন মানুষকে, যিনি শব্দকে রূপ দিয়েছেন সেতুতে, বইকে বানিয়েছেন দেশের কণ্ঠস্বর, আর স্বপ্নকে করে তুলেছেন বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুভ জন্মদিন কামরুল হাসান শায়ক। আপনার জীবন বাংলাদেশের জ্ঞানভিত্তিক ভবিষ্যতের প্রতীক হয়ে থাক।
আপডেট:: নাজমুল সুজন বিশ্বাস // শার্শা-যশোর //