স্টাফ রিপোর্টারঃ
খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায় অহরহ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে রেকর্ড গড়েছে ময়ূরী প্রকল্পের প্লট বরাদ্দের অনিয়ম-দুর্নীতি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ইচ্ছেমতো দুই দফায় ৪৭টি প্লট ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়। প্লট পাওয়ার তালিকায় নাম লেখিয়েছেন সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা, সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও কেডিএর চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সবাই মিলেমিশে সস্তায় প্লটগুলো বাগিয়ে নেওয়ায় সংস্থাটির ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা, যা নিয়ে ভেতর-বাইরে রয়েছে চাপা ক্ষোভ।
কেডিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে খুলনা নগরীর পশ্চিম প্রান্তে সিটি বাইপাসসংলগ্ন আহসানাবাদ মৌজায় ৯০ একর জমিতে ‘ময়ূরী’ নামে একটি আবাসিক প্রকল্পের কাজ শুরু করে কেডিএ। প্রকল্পে প্লট বিক্রির জন্য আবেদন ফরম বিক্রি শুরু হয় ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট। নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ জামানত দিয়ে প্লটের জন্য ২ হাজার ৩৬০ জন আবেদন করেন। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কয়েক ধাপে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬২৮টি প্লট। তবে নানা কারণে আবেদন বাতিল ও ২০২০ সালে প্রকল্পের অবকাঠামোর কাজ শেষ হলে বেশ কিছু প্লট ফাঁকা পাওয়া যায়। নিয়ম অনুযায়ী, আবেদনকারীদের মধ্যে ওই প্লট বরাদ্দ হওয়ার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। নিয়য়ের শর্ত ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ৩২টি এবং ২০২২ সালের মে মাসে ১৫টি প্লট অন্যদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়।
৩২টি প্লট : পাঁচ কাঠার প্লট বাগিয়ে নেন তৎকালীন অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে পদে থাকা খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী, সংরক্ষিত নারী-৩০ আসনের এমপি গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, কেডিএর চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ আব্দুল মুকিম সরকার, পরিচালক (প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা) ড. মোঃ শাহানুর আলম ও পরিচালক এস্টেট ছাদেকুর রহমান, খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক সাইফুর রহমান খান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব লুৎফুন নাহার, প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব ও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হেমন্ত হেনরী কুবি, দুদকের সাবেক সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, বিএল কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রভাষক মোঃ রেজাউল করিম, আবুল মিন্টু ও অ্যাডভোকেট টিএম শাকিল হাসান, ডিআইজি হাফিজুর রহমান, পূর্ত (অডিট) বিভাগের মহাপরিচালক আনিচুর রহমান, ঢাকার কলাবাগানের বাসিন্দা মারুফ হোসেন, খুলনার হাজি মেহের আলী রোডের বাসিন্দা রুবায়াৎ নাদিরা ও খুলনার বাসিন্দা সরদার আল মাসুম।
তিন কাঠার প্লট বরাদ্দ পান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত আহমেদুল কবীর, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন, খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন, কেসিসির সচিব মোঃ আজমুল হক, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মোঃ ইকবাল হোসেন, তেরখাদার বাসিন্দা মোল্লা বদরুল আলম, যশোরের পুরাতন কশবার বাসিন্দা মোঃ সাইফুর রহমান, মিরপুরের বাসিন্দা মোঃ সহিদুল ইসলাম, কেডিএর ১৪ কর্মচারীর নামে চারটি, কেডিএর সহকারী প্রকৌশলী মুনতাসির মামুন, খুলনার বাসিন্দা সৈয়দ ফজলে বারী, মাগুরার বাসিন্দা মোঃ.রাজু আহমেদ ও খুলনার স্থানীয় পত্রিকার একজন প্রকাশক।
১৫টি প্লট : পাঁচ কাঠার প্লট বাগিয়ে নেন তৎকালীন অর্থাৎ ২০২২ সালের মে মাসে পদে থাকা খুলনা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আকতারুজ্জামান বাবু, কেডিএর বোর্ড সদস্য ও সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) রুনু রেজা, পরিচালক (এস্টেট) মোঃ বদিউজ্জামান ও নগরীর নিরালার বাসিন্দা ইকবাল খান।
তিন কাঠার প্লট বরাদ্দ পান কেডিএর বোর্ড সদস্য ও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নায়লা আহমেদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা, কেডিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দীপংকর দাশ, কেডিএ বোর্ড সদস্য ও কেএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এসএম ফজলুর রহমান, প্রাক্তন বোর্ড সদস্য আহসানুল কবীর, নগরীর ধর্মসভা এলাকার মনির হাসান, ঢাকা গ্রিনরোডের বাসিন্দা আবদুস সবুর ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার শায়লা নবী। এ ছাড়া তিন কাঠার একটি প্লট তিনজন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীর নামে ও তিন কাঠার দুটি প্লট ছয় কর্মচারী।
প্লট বরাদ্দে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি সরকারি অডিটেও উঠে এসেছে। অডিটে উল্লেখ করা হয়েছে, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৮ এর ধারা-৫২ কেডিএর চেয়ারম্যান, সদস্য, সচিব বা কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃপক্ষের কোনো পদে বহাল থাকাকালে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বা কোনো লেনদেন বা স্বার্থসংশিষ্ট বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো শেয়ার বা স্বত্ব বা দখল করবেন না উল্লেখ থাকলেও উক্ত আইন লঙ্ঘন করে এ কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে প্লট বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।
অডিটে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি ৫৪৬তম বোর্ডসভায় প্লটের জমির মূল্য কাঠাপ্রতি ১৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে ময়ূরী প্রকল্পের প্রসপেক্টাসে তিন কাঠা প্লটের কাঠাপ্রতি দর ছিল ৯ লাখ এবং পাঁচ কাঠা প্লটের কাঠাপ্রতি দর ছিল সাড়ে ৯ লাখ টাকা, যা বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট লঙ্ঘন।
এ ছাড়া প্রসপেক্টাসে তিন কাঠা প্লটের কাঠাপ্রতি ৯ লাখ এবং পাঁচ কাঠা প্লটের কাঠাপ্রতি সাড়ে ৯ লাখ টাকা নির্ধারণের পরও সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও কেডিএর চেয়ারম্যানসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে কাঠাপ্রতি মাত্র ৫ লাখ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। ফলে তিন কাঠার প্লটপ্রতি ৪ লাখ করে এবং পাঁচ কাঠার প্লটপ্রতি সাড়ে ৪ লাখ টাকা করে ক্ষতি হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্পের প্রসপেক্টাসে ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন চাওয়া হয়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৮ এর ধারা ৫২, ৫৪৬তম বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত ও প্রসপেক্টাসের শর্ত লঙ্ঘন করে বরাদ্দ দেওয়ায় কর্তৃপক্ষের বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
বরাদ্দ কমিটির সদস্যরা জানান, ২০১৫ সালে যখন ময়ূরী আবাসিক প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, তখন তাদের কেউ আবেদন করেনি। পরে আর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়নি। ৫৫২ ও ৫৫৭তম বোর্ডসভায় গোপনে দুই দফায় ৪৭ প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সাদা কাগজে লিখিত আবেদন নেওয়া হয়। বোর্ডসভায় বরাদ্দ পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলে তখন নির্ধারিত ফরম পূরণ করা হয়। কোনো যাচাই-বাছাই হয়নি। লটারিও হয়নি। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি দিলে আবেদন বেশি পড়ত। প্রতিযোগিতা হলে সংস্থার আয়ও বাড়ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, ২০২০ সালের ডিসেম্বর বছর ৩২টি ভাগবাটোয়ারা হয়। তখন কেডিএর চেয়ারম্যান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ আব্দুল মুকিম সরকার। ২০২২ সালে বর্তমান চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম মিরাজুল ইসলামের সময় ১৫টি প্লট ভাগবাটোয়ারা হয়।
তারা আরও জানান, ময়ূরী আবাসিকে প্লট বরাদ্দে নয়-ছয়ের বা ভাগবাটোয়ারার পরিকল্পনা করেন মূলত কেডিএতে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা। প্লট বরাদের নীতিমালায় উল্লেখ আছে, প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের কেডিএতে চাকরি এক বছর পূর্ণ না হলে বরাদ্দ পাবেন না। অথচ সেটিরও ব্যত্যয় ঘটেছে এ সংস্থায়। তারা পরিকল্পনা সফলভাবে করতেই প্রভাবশালীদের অনিয়মের অংশীদার করেন। ফলে দেখা গেছে, তারা কম টাকায় প্লট বাগিয়ে নিয়েছেন। অথচ বাস্তবে পাঁচ কাঠা প্লটের দাম প্রায় ২ কোটি টাকা। অনেকে প্লট বরাদ্দ পেয়েই বিক্রি করে কোটি টাকা লাভবান হন।
এ প্রসঙ্গে খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, ময়ূরী প্রকল্পে নিজেরা নিয়ম তৈরি করে সেই নিয়ম নিজেরা ভেঙেছে। বেআইনিভাবে রাষ্ট্রের সম্পদ নিজেরা ইচ্ছেমতো মিলেমিশে লুটপাট করেছে। ফলে এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের মুখোমুখি করা উচিত।
এ ব্যাপারে কেডিএর পরিচালক (এস্টেট) জাকিয়া সুলতানা কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে প্রতিষ্ঠানের সদস্য (এস্টেট) মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, বিষয়টি তার ভালো জানা নেই। তবে যদি অডিটে আপত্তি থাকে সেটি অফিস মোকাবিলা করবে। আর যদি অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়, তাহলে সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।
তবে কেডিএর চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম মিরাজুল ইসলাম বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে অডিট ও মন্ত্রণালয়ের তদন্ত হয়েছে। অডিট ও তদন্তে যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে সবকিছু চলমান রয়েছে। এর বাইরে তার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।