
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ পর্যটন গন্তব্য মালয়েশিয়া এবার বিশ্ব পর্যটন মঞ্চে নতুন করে নিজেকে হাজির করছে। আসন্ন ভিজিট মালয়েশিয়া ২০২৬ (VM2026)-কে সামনে রেখে দেশটির পর্যটনশিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে রাজধানী কুয়ালালামপুরে আয়োজন করা হলো গ্লোবাল ট্যুরিজম মিট ২০২৫ (GTM2025)—যা শুধু একটি সম্মেলন নয়, বরং মালয়েশিয়ার ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি পুনর্গঠনের কৌশলগত প্ল্যাটফর্ম।
১ থেকে ৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে অংশ নেয় ৬০০ আন্তর্জাতিক ক্রেতা, ১০০ গণমাধ্যম প্রতিনিধি এবং ৪০০ মালয়েশিয়ান সেলার। হোটেল, ট্রাভেল এজেন্সি, এয়ারলাইন্সসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখানে নিজেদের সম্ভাবনা উপস্থাপন করে। বিজনেস-টু-বিজনেস (B2B) বৈঠক, ফ্যামিলিয়ারাইজেশন ট্রিপস ও নেটওয়ার্কিং সেশন-এর মাধ্যমে মালয়েশিয়া তুলে ধরে তার বৈচিত্র্যময় পর্যটন সম্ভাবনা।
পর্যটন, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপমন্ত্রী দাতুক খাইরুল ফিরদাউস আকবর খান বলেন, “গ্লোবাল ট্যুরিজম মিট কেবল একটি ইভেন্ট নয়; এটি নতুন ধারণাকে কর্মপরিকল্পনায় রূপ দেওয়ার একটি মঞ্চ। সরকার, শিল্পখাত ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ভিজিট মালয়েশিয়া ২০২৬-কে সাফল্যমণ্ডিত করবে।”
২০২৪ সালে মালয়েশিয়া ৩৮ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ করেছে, যা মহামারির পর রেকর্ড প্রবৃদ্ধি। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া শীর্ষ পর্যটক উৎস দেশ। শুধু এ বছর জানুয়ারি-জুলাই মাসেই ভ্রমণ করেছে ২৪.৫ মিলিয়ন পর্যটক, যা আগের বছরের তুলনায় ১৬.৮% বেশি।
মালয়েশিয়ার প্রধান প্রতিযোগীরা হলো থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর—যারা প্রত্যেকেই নিজেদের আলাদা ব্র্যান্ডিং কৌশল নিয়ে বৈশ্বিক পর্যটন বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।
দীর্ঘদিন ধরে ‘অ্যামেজিং থাইল্যান্ড’ ব্র্যান্ডিং-এর মাধ্যমে পর্যটনশক্তি ধরে রেখেছে। বিশেষ করে ওয়েলনেস ট্যুরিজম, নাইটলাইফ, এবং মেডিকেল ট্যুরিজমে তাদের প্রভাবশালী অবস্থান রয়েছে। ২০২৪ সালে থাইল্যান্ড প্রায় ৪০ মিলিয়ন পর্যটক আকর্ষণ করেছে এবং ২০২৫-এ আরও উচ্চ লক্ষ্য স্থির করেছে।
ইন্দোনেশিয়া বালিকে কেন্দ্র করে তাদের পর্যটন কৌশল সাজিয়েছে। সরকার ২০২৫-এ “10 New Balis” উদ্যোগ চালু করেছে, যাতে বালি-নির্ভরতা কমিয়ে লম্বক, লাবুয়ান বাজো ও তোরাজার মতো নতুন গন্তব্যকে বৈশ্বিক মানচিত্রে আনা হয়। টেকসই পর্যটন ও ইকো-ট্যুরিজমে তারা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।
সিঙ্গাপুর ছোট দেশ হলেও কৌশল ভিন্নধর্মী। তারা নিজেদের ‘প্রিমিয়াম আরবান ট্যুরিজম’ গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মারিনা বে স্যান্ডস, সেন্টোসা, ইউনিভার্সাল স্টুডিওসসহ আধুনিক বিনোদন ও কনফারেন্স ট্যুরিজম (MICE) তাদের মূল শক্তি। ২০২৪ সালে সিঙ্গাপুর প্রায় ১৩ মিলিয়ন পর্যটক পেয়েছে, তবে মাথাপিছু ব্যয়ের দিক থেকে তারা শীর্ষে।
এই প্রেক্ষাপটে মালয়েশিয়ার চ্যালেঞ্জ হলো—একদিকে থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামলানো, অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের মতো প্রিমিয়াম অভিজ্ঞতা-নির্ভর বাজারে টিকে থাকা। এজন্য মালয়েশিয়া তার স্লোগান “ডাইভার্সিটি ইন ইউনিটি” সামনে এনে সংস্কৃতি, ইকো-ট্যুরিজম, স্বাস্থ্য ও ওয়েলনেস ট্যুরিজমে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে চাইছে।
এবারের সম্মেলনে মালয়েশিয়ার জাতীয় ও বেসরকারি এয়ারলাইনগুলো—মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, এয়ারএশিয়া ও বাতিক এয়ার—প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি MICA ও MITTA-র মতো সংগঠন এবং করপোরেট অংশীদাররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং বৈশ্বিক পর্যটন প্রতিযোগিতায় GTM2025 মালয়েশিয়াকে নতুন শক্তি জুগিয়েছে। পর্যটন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি সরকার ও শিল্পখাত যৌথভাবে কৌশল বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পর্যটনে একটি “গেম-চেঞ্জার” হয়ে উঠবে।
ইউআরএল কপি করা হয়েছে