ছোট্ট আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থার জন্য জুস, ললিপপ, চিপস আনবে কে?

বাংলাদেশ চিত্র ডেস্ক

ছয় বছরের ছেলে আব্দুল্লাহ ও চার বছর বয়সী মেয়ে ফারিস্থা। বাবা আবুল কালাম আজাদ (৩৬) প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় ফেরার সময় তাদের জন্য জুস, ললিপপ, চিপস নিয়ে আসতেন। আর সকালে তিনি জামা-কাপড় পড়ে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছুটে আসত আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থা। জানতে চায় বাবা তুমি কোথায় যাবে? বাবা বলতো অফিসে। তখনই তারা বলে উঠত আমরাও যাবো। আমাদের নেবে না? বাবা তখন বলত— এইতো রাতেই ফিরে আসবো। সে সময় ছেলে ও মেয়ের বায়না ধরতো—বাবা তুমি জুস, ললিপপ, চিপস আনবে কিন্তু।

প্রতিদিনের মতো নারায়ণগঞ্জ থেকে আজ রবিবার (২৬ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর মতিঝিলে অফিসে এসেছিলেন আবুল কালাম আজাদ। সেখান থেকে দুপুরে ফার্মগেট এলাকায় আসেন তিনি। এ সময় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে তার ওপর। এতে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি।

ছোট্ট আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থার বাবা এখন আর বেঁচে নেই। তাদের জুস, ললিপপ, চিপস আনার বায়না আর পূরণ হবে কিনা এখনও জানে না তারা। কিন্তু তাদের বাবা আর কখনো জুস, ললিপপ, চিপস নিয়ে বাসায় ফিরবেন না।

ঘটনার পরপরই ফার্মগেট এলাকা থেকে নিহত আবুল কালাম আজাদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও থানায়। গণমাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর জানতে পারেন পরিবারের সদস্যরা। দুপুরের পর থানায় এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তার স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়া। সঙ্গে ছিলেন ছোট্ট আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থা।

সন্ধ্যার দিকে তেজগাঁও থানার ওয়েটিং রুমে গিয়ে আবুল কালাম আজাদের স্ত্রী আইরিন আক্তার প্রিয়া ও ছোট্ট আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থার দেখা মেলে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা ও কাতর হয়ে সোফায় বসে আছেন প্রিয়া। আর ছোট্ট আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থা তার কোলে বসে আছে। আবার সোফায় বসেও খেলা করছে দুজন।

আইরিন আক্তার প্রিয়া জানান, প্রতিদিনের মতো সকাল বেলা কোনো কিছু না বলে গোসল করে জামা পরে বেরিয়ে যায় আবুল কালাম। গতকাল রাতে সর্বশেষ ২টায় কথা হয় তার সাথে। তখন বলেছিল, ২ সন্তান নিয়ে আমাদের সুখী পরিবার। এদের ভবিষ্যৎ গড়তে আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তাই সকাল ৮টা থেকেই বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে আব্দুল্লাহ ও ফারিস্থার বাবা। যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল দুই ছেলে-মেয়েকে না জানিয়ে আস্তে আস্তে এসে দরজা লাগাতে বলেন। কে জানতো এ বিদায় শেষ বিদায় হবে।

দুপুরে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের গার্ডারের নিচে হঠাৎ বিকট শব্দে খুলে পড়ে বিয়ারিং প্যাড। সে সময় নিচে থাকা আবুল কালাম আজাদের উপর বিয়ারিং প্যাড ছিটকে পড়ে। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন আবুল কালাম। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে তার। মিনিটের মধ্যেই রক্তে লাল হয়ে যায় ফুটপাত।

তার বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কিশোরকাটি গ্রামে। ঢাকার পাশে পরিবার নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলী এলাকায় বসবাস করতেন।

জানা গেছে, ঢাকার মতিঝিল ও উত্তরায় বিমানের টিকিটিং এ ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কাজ করতেন। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে নিহত কালামের স্বপ্নের রাজ্য। পেশাগত কাজের সূত্রেই তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকার মতিঝিল, ফার্মগেট, উত্তরায় যাতায়াত করতেন।

আজ সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে ঘুরে দেখা যায়, ফুটপাতে নেই কামালের সেই রক্তের দাগ। পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে। সড়ক বন্ধ করে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ একাধিক ক্রেনের সাহায্যে ক্ষতিগ্রস্ত বিয়ারিং প্যাড মেরামতে কাজ করছে। বন্ধ রয়েছে মেট্রোরেল চলাচল। ঘটনাস্থলে দুই হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে আবার কাজে ফিরে এসেছেন আহত হেলাল। বেঁচে যাওয়ার মুহূর্তটি বর্ণনা করছেন গণমাধ্যমকর্মীদের। পাশেই চা দোকানি আমির ভেঙে যাওয়া দোকানের জিনিসপত্র খুঁজছেন।

বিয়ারিং প্যাডের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিটি পিলারের সঙ্গে রাবারের বেয়ারিং প্যাড থাকে, যার প্রতিটির ওজন আনুমানিক ১৪০-১৫০ কেজি। এসব বেয়ারিং প্যাড ছাড়া ট্রেন চালানোটা ঝুঁকিপূর্ণ। এর আগে ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটের কৃষিবিদ ইনিস্টিটিউটের সামনের পিলার থেকে একইভাবে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিলো। যদিও সেদিন কেউ হাতাহত হয়নি।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হেলাল বলেন, দুপুর ১২টা ১০ মিনিটের সময়ে এই ঘটনা ঘটে। এর কিছু সময় আগে মনিপুর পাড়া থেকে আমিরের চায়ের দোকানে এসে বসি। দুপুর হওয়ায় লোকজন কম ছিলো। এই সময়ে যিনি মারা গেছেন, তিনি একা হেঁটে যাচ্ছিলেন। মেট্রোরেলের লাইনে একটি ট্রেন যাওয়ার পরেই বিকট শব্দ হয়ে। এর কয়েক সেকেন্ড পরে তাকিয়ে দেখি ফুটপাতে একজনের মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর মেট্রোরেলের কৃষিবিদ ইনিস্টিটিউটের সামনে ৪৩০ নম্বর পিলারের বেয়ারিং প্যাড ছিটকে পড়ে। তখন একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এবার মাত্র ৫০ গজের মধ্যে ৪৩২ নাম্বার পিলারের বেয়ারি প্যাড ছিটকে পড়ে পথচারী আবুল কালামের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাস্থলের দুই পাশেই সরকারি প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল রয়েছে। ফলে আতঙ্ক নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে রাজধানীর বাসিন্দাদের।

Share This Article