শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপে মূল্যায়ন অপরিহার্য। একমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থীর এক বছরের শিখনদক্ষতার মূল্যায়ন সম্ভব। পরীক্ষা কেবল শিখনের ফলাফল যাচাই করে না। শিক্ষার্থীদের অধ্যবসায়, মনোযোগ ও প্রতিযোগিতার মানসিকতা গড়ে তোলে পরীক্ষাপদ্ধতি। এ কারণে প্রাথমিক স্তরের শেষে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষাও সমানভাবে প্রয়োজনীয় বলে প্রতীয়মান হয়।
একজন শিক্ষার্থীর শিখনদক্ষতা মূল্যায়নের সবচেয়ে কার্যকর উপায় পরীক্ষাপদ্ধতি। শিক্ষার্থীদের এক বছরে শেখা জ্ঞান, দক্ষতা ও অধ্যবসায়ের সঠিক চিত্র কেবল পরীক্ষার মাধ্যমেই আমরা পেতে পারি। বিকল্প হিসেবে আমরা অন্য কোনো পদ্ধতি কার্যকর হতে দেখি না। যদি শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে, তবে এর প্রভাব পড়বে তাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষা ও ক্যারিয়ারে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দুটি বৃত্তি পরীক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা হলো প্রাথমিক স্তরের শেষ ধাপের মূল্যায়ন। অপর দিকে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা নিম্নমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সার্বিক মূল্যায়ন। এ মূল্যায়ন পরবর্তী সময়ে মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে মজবুত ভিত্তি তৈরি করে। অন্যভাবে বলা যায়, এটি মাধ্যমিক শিক্ষার প্রথম সোপান। তাই এই পরীক্ষার গুরুত্ব কেবল বৃত্তিপ্রাপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষাজীবনের পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যেতেও সহায়ক হবে বলে মনে করি।
করোনা মহামারির শুরুর দিকে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেরও বিদ্যালয়গুলো দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল। এ সময় বিকল্প হিসেবে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক শিক্ষা চালু করা হয়। কিন্তু এটি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়নি। এর কারণ হিসেবে নিচের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা যায়—
১. অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি মূলত বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের জন্য উপযুক্ত, স্কুল স্তরের জন্য নয়।
২. অধিকাংশ শিক্ষার্থী নেট বা গুগল থেকে উত্তর কপি করে জমা দিয়েছে, ফলে বিষয়বস্তুর প্রতি কোনো বোঝাপড়া তৈরি হয়নি।
৩. অনেক অভিভাবক শিক্ষার্থীর পরিবর্তে নিজেরাই উত্তর লিখে দিয়েছেন।
৪. এর ফলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞানার্জন হয়নি। ফলে তাদের শিখনদক্ষতায় গুরুতর ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
আজও সেই শিক্ষাগত ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। তাই শিক্ষার্থীদের আবার পড়াশোনায় ফেরাতে এবং শিক্ষার মান পুনর্গঠনের জন্য একটি সামগ্রিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বাড়াবে বহুগুণে। তারা জানবে যে বছরের শেষে একটি বড় পরীক্ষা রয়েছে, তাই অবহেলা করলে চলবে না। এ পরীক্ষার প্রস্তুতি তাদের নিয়মিত পড়াশোনার অভ্যাস তৈরি করবে। একই সঙ্গে যোগ্য নাগরিক হিসেবেও তাদের অবস্থান প্রাথমিক পর্যায়ে দৃঢ় হবে।
তাদের মধ্যে আমরা যেসব বিষয়গুলো পাব, তা হলো—
১. ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে শোনা,
২. বাড়ির কাজ নিয়মিত সম্পন্ন করা,
৩. বইপত্র, পত্রিকা ও নোট করে অধ্যয়নের অভ্যাস তৈরি করা,
৪. নিয়মিত পাঠ পুনরাবৃত্তি করা,
৫. সময়মতো রুটিন মেনে পড়াশোনা,
৬. শিক্ষকের নির্দেশনা মেনে চলা,
৭. সহপাঠীদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি,
৮. প্রশ্ন সমাধানের অনুশীলন,
৯. গবেষণানির্ভর মানসিকতা তৈরি,
১০. আত্মবিশ্বাস ও প্রতিযোগিতার মানসিকতা।
জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থীর মানসিক ও মেধা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এটি তাদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার মানসিকতা জাগিয়ে তুলবে, নিয়মিত অধ্যবসায়ের অভ্যাস গড়ে তুলবে এবং সফলতার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। একই সঙ্গে শিক্ষার মান উন্নয়নে সহায়তা করবে এবং জাতীয় পর্যায়ে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দেওয়ার মতো দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ভিত্তি স্থাপন করবে।
শিক্ষার্থীদের কোভিড-জনিত শিখন–ঘাটতি পূরণ করতে হলে এখনই তাদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনা দরকার। এ জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে শিশুরা পড়াশোনায় উত্সাহ পায়। পাশাপাশি তাদের নিয়মিত মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বোঝা যায়, তারা কতটা শিখছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার মতো পরীক্ষা চালু রাখা; কারণ, এ ধরনের পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বাড়ায়।