
অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য সাত দিনের সময়সীমা দিয়েছিল। সোমবার (১০ নভেম্বর) সেই সাত দিন শেষ হচ্ছে, কিন্তু দলগুলোর মধ্যে এখনও কোনও সমন্বয় বা ঐক্যের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অধিকাংশ দল এখনও তাদের আগের অবস্থানেই অনড় রয়েছে।
বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটের প্রস্তাবে অনড় রয়েছে, যা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে তারা দেখছে। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং আরও কয়েকটি দল এ মাসের মধ্যেই গণভোট আয়োজনের জন্য সরকারের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করছে।
গত ৩ নভেম্বর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আর গণভোটের দিনক্ষণ নিয়ে মতবিরোধ দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারি সূত্র জানিয়েছিল, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে প্রধান উপদেষ্টা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
সেই অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ‘জুলাই জাতীয় চার্টার বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ জারি করতে পারে এবং প্রস্তুতিও চলছে। খসড়া আদেশটি বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হতে পারে। গণভোটের তারিখ নির্ধারণ করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের সুপারিশ জমা দেয়। ওই নথিতে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংশোধন) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫-এর দুটি খসড়া অন্তর্ভুক্ত ছিল।
খসড়ায় বলা হয়েছে, সাংবিধানিক প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংশোধন আইনের অধীনে খসড়া বিল হিসেবে প্রস্তুত করা হবে এবং গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটে অনুমোদিত হলে সাংবিধানিক সংস্কার পরিষদ প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করবে, মূল ভাব বজায় রেখে। পরবর্তী সংসদ যদি ২৭০ দিনের মধ্যে তা অনুমোদন না করলে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে।
খসড়ায় ৪৮টি সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যার মধ্যে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক (পিআর) উচ্চকক্ষ গঠন অন্যতম। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে, আদেশ ও গণভোট নির্বাচন-পূর্ব না নির্বাচন-সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একটিমাত্র প্রশ্ন নিয়ে গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে ভোটাররা কেবল ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন। প্রস্তাবিত গণভোট অধ্যাদেশ অনুমোদিত হলে এটি জুলাই চার্টারের আইনি ভিত্তি হিসেবে কার্যকর হবে। যদিও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘নোট অব ডিসেন্ট’ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছিল, তবে সেটি তফসিলের অন্তর্ভুক্ত নয়—কারণ গণভোটে কোনও ভিন্নমত থাকবে না।
তবে বিএনপি আদেশ নয়, বরং ঘোষণার মাধ্যমে গণভোট আয়োজনের পক্ষে। দলটি চায় গণভোটে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকুক, যাতে কোনও দল যদি কোনও প্রস্তাবে আপত্তি জানায় এবং পরবর্তীতে নির্বাচনে জয়ী হয়, তাহলে সংশোধনীটি তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী বাস্তবায়িত হতে পারে। বিএনপি দাবি করছে, গণভোট অবশ্যই নির্বাচনের দিনই হতে হবে। বিপরীতে, জামায়াত ও এনসিপি ভিন্নমত ছাড়াই গণভোট চায়। জামায়াত ও আরও আটটি দল ইতোমধ্যে নির্বাচন-পূর্ব গণভোটের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ সরকারের এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘আপনারা কোনও নির্বাচিত সরকার নন, এটা আপনারা যেন সব সময় ইয়াদ (মনে) রাখেন। আপনাদের এ রকম কোনও এখতিয়ার নাই, আমাদের ডিকটেট (আদেশ) করার যে সাত দিনের ভিতরে আপনারা সিদ্ধান্ত না হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের বোধহয় মানায় না।’
দলটির এই নেতা আরও বলেন, ‘বিএনপি সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, সেটা এনসিপি হোক, জামায়াত হোক বা অন্যান্য পার্টি হোক। সবার সঙ্গে আমরা গণতান্ত্রিক কালচার (সংস্কৃতি) হিসেবে রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং আলাপ-আলোচনা, সম্পর্ক রাখবো। কিন্তু কোনও বিষয়ে আলোচনা করার জন্য কোনও রেফারির ভূমিকায় কোনও দলকে দিয়ে আপনারা আহ্বান জানাবেন ইনডাইরেক্টলি, সেটা বোধহয় সঠিক হচ্ছে না।’
সরকারের ৩ নভেম্বরের আল্টিমেটামের পর জামায়াত স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু বিএনপি সাড়া দেয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও আরও ছয়টি দল মঙ্গলবার ঢাকায় বড় সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে, যেখানে জুলাই সনদ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবিতে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করা হবে, যার অন্যতম নির্বাচন-পূর্ব গণভোট আয়োজন।
সম্প্রতি ঢাকার এক হোটেলে ‘প্রযুক্তিনির্ভর নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা’ শীর্ষক এক সংলাপে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, ‘বিএনপির মহাসচিবকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু ওনারা বলেছেন জামায়াতের আহ্বানে তারা সাড়া দেবেন না। বিগত রেজিম কিন্তু এ ধরনের সুর সবসময় বাজাতো যে অমুকের সঙ্গে বসবে না। এই কালচার থেকে কি বের হতে পারি না? বিএনপি যদি আহ্বান করে জামায়াত যাবে এবং অন্যদেরও আহ্বান জানাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং আইনানুগ উপায়ে জনমত গঠনের চেষ্টা করছি। আমরা কোনও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নই; আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি, মতামত তুলে ধরছি এবং সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছি।’
অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘একটা দল বলছে গণভোট হতে হবে নির্বাচনের আগে। আমরা বলছি গণভোট যদি হতেই হয় নির্বাচনের দিনে হতে পারে। গণভোট, সনদ এগুলো আমরা বুঝি না, জনগণ বোঝে না। কিছু ওপর তলার লোক আমেরিকা ও অন্য জায়গা থেকে এসে এগুলো আমাদের ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তবে আমরা বিএনপি থেকে বলেছি, এগুলো আমরা মেনে নিয়েছি। পরিবর্তন আমরা চাই, তবে যে পরিবর্তনগুলোতে আমরা একমত নই সেগুলো নির্বাচিত সংসদে গিয়ে তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
এতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ছয়দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টিসহ নয় দলের যে উদ্যোগ, সেটিও এগোয়নি। সমঝোতার জন্য সরকারের বেঁধে দেওয়া সাত দিনের সময়সীমা সোমবার শেষ হচ্ছে। সময় যতো যাচ্ছে এই অচলাবস্থা রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সম্প্রতি বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু তা দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়নি। বিএনপি স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, আর জামায়াত দ্বৈত চরিত্র দেখিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। সামগ্রিকভাবে এখনও কোনও ঐক্য হয়নি।’
তিনি সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘সরকার যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে বল তুলে দিয়েছে, আমি মনে করি সেটা খুব অন্যায় কাজ করেছে। আসলে এই সংকটটা ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের তৈরি করা। কারণ তারা দলগুলোর অবস্থান জানে। এখন সমাধানের পথ এবং দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? দাঁড়ানোর জায়গাটা ছিল, দলগুলো যেখানে ঐকমত্য পোষণ করেছে সেটাই তো ঐকমত্যের জায়গা হওয়ার কথা। যেসব প্রশ্নে ঐকমত্য হয়নি, সেসব তো কোনোভাবেই সবার সিদ্ধান্ত হিসেবে চাপানো উচিত হয়নি। সমস্যা আসলে তৈরি হয়েছে এখানেই।’
তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, ‘সরকার যদি দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে রাজনৈতিক সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে।’