
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সম্ভাব্য নাশকতা প্রতিরোধে শুরু হয়েছে সাঁড়াশি অভিযান, বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায়।
আগামী বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করবেন। এই ঘটনাকে ঘিরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশজুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি ও সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলটির পলাতক নেতাকর্মীরা নানা ধরনের উসকানি ও হুমকি ছড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ডিএমপির সদরদফতর জানিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। যেকোনো ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে পুলিশ।
গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন সময় রাজধানীতে মিছিল কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। লকডাউন ঘোষণার পরও বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করতে গেছে দলটির নেতাকর্মীদের।
এদিকে, আওয়ামী লীগের লকডাউন কর্মসূচির আগে সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাই ১৩ নভেম্বর বড় ধরনের নাশকতার শঙ্কা না করলেও বিষয়টি একেবারে হালকাভাবে নিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
একের পর এক ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন
সেমাবার (১০ নভেম্বর) রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, মিরপুর, বাংলামোটরসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে। মেরুল বাড্ডা, শাহজাদপুর ও সায়েন্সল্যাব এলাকায় তিনটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগের প্রতিটি ঘটনাস্থল ঘিরে তদন্ত চলছে এবং দায়ীদের শনাক্তে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানিয়েছে, রাজধানীতে এক লাখ গ্যাস বেলুন উড়িয়ে রাজনৈতিক বার্তা ছড়ানোর পরিকল্পনা করার অভিযোগে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ২৫ নেতাকর্মীকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। রবিবার (৯ নভেম্বর) ডিএমপির পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
এর আগের দিন শনিবার (৮ নভেম্বর) ডিএমপি সদরদফতরে এক জরুরি বৈঠকে ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) নির্দেশ দেওয়া হয়—যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে এবং গ্রেফতার অভিযান জোরদার করতে। পরদিন থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে সাত হাজার পুলিশ সদস্যের টহল ও মহড়া শুরু হয়। র্যাব ও বিজিবির সদস্যরাও প্রস্তুত রয়েছে যেকোনও সহিংসতা প্রতিরোধে।
ডিএমপি ও র্যাব সূত্র জানায়, ১০ নভেম্বর থেকে ঢাকার প্রবেশপথ, হোটেল, মেস এবং বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে বিশেষ তল্লাশি শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে সাইবার মনিটরিং, গ্রেফতার অভিযান ও টহল বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদরদফতর সব থানাকে নির্দেশ দিয়েছে যেন বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঢুকতে না পারে। এজন্য গণপরিবহন, রেল ও নৌপথেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গোষ্ঠী নাশকতার হুমকি দিচ্ছে। আমরা বিষয়টি আমলে নিয়ে মাঠে আছি। কেউ যদি নাশকতার চেষ্টা করে, কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এমজেডএম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, ‘১৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে আমরা সাইবার মনিটরিং, টহল এবং গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করেছি। এটি গুজব হোক বা বাস্তব পরিকল্পনা—আমরা প্রতিটি তথ্য যাচাই-বাছাই করছি। দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় আমরা সতর্ক আছি।’
র্যাব ও পুলিশ উভয় সূত্রই মনে করছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের এখন বড় ধরনের সংঘাত সৃষ্টির সক্ষমতা নেই, তবে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ও উসকানিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে।
এদিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দলটির বিদেশে পালিয়ে থাকা কিছু নেতা অনলাইনে “লকডাউন” ঘিরে নাশকতা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশের ভেতরে তাদের সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক দুর্বল হলেও, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
পুলিশ সদরদফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে আগাম তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তৎপরতা চলছে। কেউ অবৈধ কর্মকাণ্ড, নাশকতা বা সংঘর্ষের চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ সরকার পালিয়ে গেছে গণমানুষের প্রতিরোধে। এখন তারা বিদেশ থেকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তবে জনগণই তাদের প্রতিরোধ করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে এবং থাকবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগের ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচি মূলত রাজনৈতিক প্রতীকী প্রতিবাদ হলেও এর আড়ালে থাকতে পারে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কৌশল। তাদের মতে, আওয়ামী লীগের লকডাউন কোনও বাস্তব আন্দোলন নয়, বরং এটা তথ্যযুদ্ধের অংশ। সরকার ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার জন্য এমন প্রচারণা চালানো হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে এখন তাদের সংগঠিত কোনও শক্তি নেই।
তবে, গুজব বা অনলাইন প্রচারণা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তাই গোয়েন্দা নজরদারি ও জনসচেতনতা—দুটোই এখন সমান জরুরি বলে মত তাদের।