বাংলাদেশে প্রায় নয় হাজার তরুণ-তরুণীকে আত্মরক্ষার কলা-কৌশল এবং আগ্নেয়াস্ত্র চালনার মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার একটি অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভবিষ্যতে এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা দেশের রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা। দেশের ক্রান্তিকালে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশ নিতে পারবেন।
এ মাস থেকেই এই প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চলছে। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, জাতীয় নিরাপত্তা জোরদারে তরুণদের প্রশিক্ষিত করতে এটি একটি পাইলট প্রকল্প।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, আইডিয়াটা হলো বাংলাদেশে গণপ্রতিরক্ষা বাস্তবায়ন করা। আমাদের সামরিক ও ভৌগোলিক বাস্তবতায় এটা অপরিহার্য। সব সময় যুদ্ধ লাগবে তা নয়, কিন্তু রিজার্ভ ফোর্সের সংখ্যা বাড়ছে-এমন মনোবল থাকা জরুরি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও সামরিক অবস্থানের কারণে গণপ্রতিরক্ষা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো বিকল্প নেই। কারও যদি মৌলিক প্রশিক্ষণ থাকে, সে অন্তত জানে অস্ত্র কীভাবে চালাতে হয়। তখন তার হাতে অস্ত্র তুলে দিলে সে দেশের সেবা করতে পারবে।
দেশের ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোতে ৮ হাজার ২৫০ জন তরুণ ও ৬০০ তরুণীকে ১৫ দিনের আবাসিক এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী বাংলাদেশিরা এতে আবেদন করতে পারবেন।
সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এটিকে আত্মরক্ষামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ বলা হয়েছে। এতে জুডো, কারাতে, তায়কোন্দো ও শ্যুটিং বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে বিকেএসপির সাতটি আঞ্চলিক কেন্দ্রে এই প্রশিক্ষণ হবে। ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেককে ৪ হাজার ২০০ টাকা ভাতা ও বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া এবং পোশাক দেওয়া হবে।
ক্রীড়া উপদেষ্টা জানান, সরাসরি গুলি ছোড়ার প্রশিক্ষণ দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও অনুমোদন, বাজেট ও অবকাঠামোগত জটিলতার কারণে সেটি এখন সম্ভব হয়নি। তবে অস্ত্র চালনার অন্যান্য দিক-যেমন টার্গেট নির্ধারণ, অবস্থান নেওয়া ও ট্রিগর চাপ দেওয়া-বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
আসিফ মাহমুদ বলেন, গণপ্রতিরক্ষার ধারণা থেকেই এই উদ্যোগ। জনগণকে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত সচেতনতা ও ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দেওয়াই এর লক্ষ্য, যাতে সংকটময় মুহূর্তে তারা এগিয়ে আসতে পারে।
তিনি বলেন, দেশে নিরাপত্তা সংকট দেখা দিলে, কিংবা আমাদের ভৌগোলিক বাস্তবতায় যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে-যা অস্বাভাবিক নয়-সে জন্য প্রস্তুতি থাকা দরকার। ইউক্রেন বা গাজার যুদ্ধ আমাদের সে শিক্ষাই দেয়।
ভবিষ্যতে অবকাঠামো ও বাজেট সুবিধা হলে বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার তরুণ-তরুণীকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি। তার মতে, লাইভ রাউন্ড ফায়ারিং পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে তা জাতীয় প্রতিরক্ষায় বড় অবদান রাখবে। দশ বছরে দুই লাখ প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
সাধারণ নাগরিকদের আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। বিশ্বজুড়ে তরুণ ও সাধারণ মানুষকে অস্ত্র থেকে দূরে রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়। যদিও দাবি করা হচ্ছে সরাসরি গুলি চালনা শেখানো হবে না, তবু অস্ত্র সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানও উদ্বেগের কারণ হতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।
বিশ্বের অনেক দেশে নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের প্রচলন আছে। তবে সেসব দেশে জাতীয় কৌশল ও নীতির আলোকে এ ধরনের কার্যক্রম হয়। বাংলাদেশে এই প্রকল্পে সে রকম কোনো জাতীয় কৌশল বা নীতির অনুপস্থিতি দেখছেন বিশ্লেষকরা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক মেজর জেনারেল আ.ন.ম. মুনীরুজ্জামান বলেন, এ ধরনের কার্যক্রমের জন্য একটি জাতীয় কৌশল প্রয়োজন, যা সংসদে পাস হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে এমন কোনো নীতিমালা নেই। এটি একটি মন্ত্রণালয়ের ধারণা থেকে আসছে বলে মনে হচ্ছে। জাতীয় নীতিমালা ছাড়া এমন স্পর্শকাতর কার্যক্রম করা উচিত নয়।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে। আন্দোলনের সময় লুট হওয়া পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বহু অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে কারা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ পাবে এবং সেটি কীভাবে ব্যবহার করবে-সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
মুনীরুজ্জামান বলেন, প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই না হলে ভুল লোকজনও প্রশিক্ষণ পেতে পারে। তখন তারা এই দক্ষতা অন্য কাজে লাগাতে পারে, যা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেরই বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। কারও কারও মতে, প্রশিক্ষণ সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য দেওয়া হয়নি।
সায়মা তাসনীম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ জরুরি। আমি নিজেও আগ্রহী। তবে এই খবরটি ভালোভাবে প্রচার হয়নি। মেয়েদের জন্য এ ধরনের প্রশিক্ষণ খুবই দরকার, কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়ে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান অস্ত্র প্রশিক্ষণের ঝুঁকির দিকটি তুলে ধরে বলেন, অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ পেলে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা বেড়ে যেতে পারে। একটা অবৈধ মাফিয়া গড়ে উঠতে পারে।
প্রান্ত নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তরুণরা দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে চায়। কিন্তু আমাদের অনেকেরই অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা নেই।
আবেদনকারীদের বাছাই করতে একটি সিলেকশন কমিটি গঠন করা হবে। কমিটিতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও বিকেএসপির প্রতিনিধির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেছেন, যাতে কোনো ‘উগ্র গোষ্ঠীর’ সদস্য প্রশিক্ষণ না পায়, সে জন্য গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া হবে।
আবেদন ফরমে এসএসসি বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চারিত্রিক সনদ এবং মামলা না থাকার অঙ্গীকারনামা জমা দেওয়ার শর্ত রয়েছে।
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ভারতবিরোধী রাজনীতি কিছুটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আন্দোলনের নেতাদের বক্তব্যে গণপ্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে এসেছে। তাই এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে কেউ কেউ রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা হিসেবেও দেখছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা একটা রেটরিক বা বাগাড়ম্বর বলে আমি মনে করি। আমাদের এখানে অনেকদিন ধরে বাগাড়ম্বরের রাজনীতি চলছে।…এগুলো দিয়ে রাজনীতি করা মানে এক ধরনের উন্মাদনা সৃষ্টি করা।
প্রসঙ্গত, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ধাপে ধাপে আড়াই বছর ধরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।