
চারপাশের ব্যস্ত ও আত্মকেন্দ্রিক এই পৃথিবীতে এখনও কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজের চাওয়া-পাওয়ার বাইরে গিয়ে অন্যের জন্য ভাবেন। সেসব তরুণদের মধ্যে একজন সাদী মুহাম্মদ তামিম। সমাজের জন্য নীরবে কাজ করে যাওয়া এই তরুণ সম্প্রতি পেয়েছেন ‘স্টার এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’। সমাজসেবায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তামিমের ঝুলিতে যোগ হলো আরেক অর্জন। দৈনিক মানবাধিকার প্রতিদিন পত্রিকার প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে স্টার মিডিয়ার আয়োজনে রাজধানীর কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাকে সম্মাননাটি প্রদান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২২টি ক্যাটাগরিতে ৫০জন গুণী ব্যক্তিকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয় দৈনিক করতোয়া পত্রিকার সম্পাদক মোজাম্মেল হক এবং খ্যাতনামা অভিনেত্রী সুজাতা আজিমকে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক করতোয়া এবং ভোরের দর্পণ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মোঃ মোজাম্মেল হক। প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন এটিএন বাংলার অনুষ্ঠান উপদেষ্টা তাশিক আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক সোসাইটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার আমিনুর রহমান, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মশিউর রহমান সুমনসহ আরও অনেকে।
অনুষ্ঠানে সামাজিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননা প্রদান করা হয় তরুণ সমাজকর্মী সাদী মুহাম্মদ তামিমকে। সমাজসেবায় তার নিরলস কাজ এবং তরুণ প্রজন্মকে ইতিবাচক কাজে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টার জন্য তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পুরস্কারটি গ্রহণের পর তার চোখে ছিল তৃপ্তির হাসি, কণ্ঠে ছিল আত্মবিশ্বাস। অনুভূতি ব্যক্ত করে তামিম বলেন, ‘আসলে একটা সম্মাননা তাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, যারা কোনো নির্দিষ্ট সেক্টরে কাজ করেন। একটা পুরস্কার কাজের গতি হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। আমার জন্যও এটা কাজের প্রাপ্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা আমাকে সামনের পথে আরও অনুপ্রাণিত করবে।’
নাটোর জেলার সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া তামিমের সমাজসেবার পথচলা শুরু হয় ২০১৫ সালে। কলেজে পড়ার সময় একদিন তিনি অংশ নেন একটি রক্তদান কর্মসূচিতে। সেটাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘একদিন দেখলাম, এক ভিক্ষুক আরেক ভিক্ষুককে ভিক্ষা দিচ্ছে। সেই দৃশ্যটা আমার মাথায় ঝড় তোলে। ভাবলাম— সে যদি পারে, আমি কেন পারব না? এখান থেকেই আমার সমাজসেবার যাত্রা।’ এ উপলব্ধিই তামিমকে মানুষ ও সমাজের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়। শুরুতে তাকে সহযোগিতা করেন কলেজশিক্ষক খাইরুল আলম।
যে-কোনো আয়োজনেই পুরস্কার পাওয়া যেমন আনন্দের, তেমনি প্রেরণারও। তামিম জানান, ‘স্টার এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’ প্রদান কর্তৃপক্ষ তাকে মোবাইল-ফোনে খবরটি জানান। খবরটি শোনার পর তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তার কাছে মনে হয়, এতদিনের পরিশ্রম যেন এক মুহূর্তে সার্থক হলো।
প্রায় এক দশকের এই পথচলায় তামিম একা নয়। তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সিংড়া স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’। তার সংগঠন এখন কাজ করছে চলনবিল অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে। কোনো প্রচারণা নেই, নেই গৌরবের আয়োজন— আছে কেবল সহানুভূতির টান। সংগঠনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করেন। এই তো গত মাসেই তারা চারজন শিক্ষার্থীকে বিনাবেতনে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন ও দুইজন শিক্ষার্থীর ছাত্রাবাসের বিল পরিশোধ করেছেন।
প্রতিটি সমাজকর্মীর পথেই যেমন আলো থাকে, তেমনি থাকে আঁধারও। তামিম বলেন, ‘সমাজসেবার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ফান্ড সংগ্রহ করা এবং আসল ভুক্তভোগীকে শনাক্ত করা। অনেক সময় বোঝা যায় না, কার সত্যিকার অর্থে সাহায্যের প্রয়োজন।’ প্রতিকূলতা থাকলেও তিনি ও তার সংগঠন থেমে থাকেননি। এমনকি মাদকবিরোধী প্রচারণা চালাতে গিয়ে মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত পেয়েছেন। কাজ করতে গেলে বাধা আসবেই জেনেও তামিমদের পথচলা থেমে নেই।
সব মানবিক কাজের পেছনে থাকে কিছু অনুপ্রেরণার মানুষ। তামিমও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাদের কথা বলেন। যাদের নিয়ে তিনি স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠন গড়ে তুলেছেন, তাদের মধ্যে তার বড় ভাই সোয়েব মুহাম্মদ অন্যতম। তিনি সবসময় পাশে থাকেন। এছাড়া সংগঠনের সিনিয়র সংগঠক তরুণ লেখক মোহাম্মদ অংকন ও মির্জা মুহাম্মদ শাফি কালাম সংগঠনের কাজের জন্য দিকনির্দেশনা দেন। তারা কাজের সহজ পদ্ধতিগুলো বুঝিয়ে দেন, যেগুলো তামিমকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তরুণ সমাজসেবক হিসেবে ‘স্টার এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০২৫’ সম্মাননা তামিমের দায়িত্ববোধ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি জানান, ‘আমরা চলনবিলের মহিলা শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর মধ্য দিয়েই আমরা শিক্ষা ও সামাজিক পরিবর্তন দুটো লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে চাই।’
তামিম শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বেশি গুরুত্ব দিতে চান। কেননা, সুশিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। পাশাপাশি মানবাধিকার ও পরিবেশ সংরক্ষণের কাজেও তাদের মনোযোগ বাড়াচ্ছে। তামিমের সমাজসেবামূলক কাজের মধ্যে অন্যতম গর্বের কাজ হলো মাদকবিরোধী কার্যক্রম। তিনি প্রায় ৫০জনকে মাদকাসক্তি থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। এখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বা ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এটা তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
তামিম মনে করেন, সমাজ পরিবর্তনে তরুণদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তরুণরাই পারে একটি জাতিকে এগিয়ে নিতে। শুধু মানসিকতা বদলালেই তারা সমাজসেবায় যুক্ত হতে পারে। তাই তরুণদের উদ্দেশ্যে তার পরামর্শ, ‘প্রাপ্তির আশায় নয়, দায়িত্ববোধ থেকে কাজ করতে হবে। সৎ সাহস আর লক্ষ্য থাকলে বাধা জয় করা সম্ভব। আমার এখন স্বপ্ন একটাই— সারাজীবন মানুষের পাশে থাকা। আমি চাই মানুষ আমাকে একজন সমাজসেবক ও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেই চিনুক।’