বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে নেতৃত্ব, সংগ্রাম ও ত্যাগের প্রশ্ন এলে কিছু নাম স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয়। জনাব তারেক রহমান সেই নামগুলোর একটি। পিতৃহারা হওয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, নির্বাসন সবকিছুর ভেতর দিয়েও তিনি আজ কোটি মানুষের আশার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে ছোট্ট পিনু হারান তাঁর পিতাকে। শৈশবেই তিনি উপলব্ধি করেন রাজনীতি কেবল ক্ষমতার বিষয় নয়; এটি জীবন বাজি রেখে জনগণের সেবা। পরবর্তীতে তাঁর মা বেগম খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী হলেও পরিবার প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। এই ব্যক্তিগত বেদনাই তারেক রহমানকে রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় ও সংগ্রামী করেছে।
১৯৮০-এর দশকের শেষভাগে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-যুব আন্দোলনের সময় তারেক রহমান সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। যদিও তখন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতির কেন্দ্রীয় মঞ্চে ছিলেন না, তবে আন্দোলনকারীদের প্রেরণা ও সংগঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাঁর নাম উঠে আসে। ১৯৮৮ সালে সরাসরি দাদা বাড়ি গাবতলী বগুড়াতে তৃণমূলের সাধারণ সদস্য হিসাবে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। তারেক রহমান রাজনীতিকে দেখেছেন কেবল ক্ষমতার প্রতিযোগিতা হিসেবে নয়; বরং তিনি এটিকে দেখেছেন সাধারণ মানুষের জীবনের অংশ হিসেবে। পিতার আদর্শকে ধারণ করে মাইলের পর মাইল হেঁটে বেরিয়েছেন দেশের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। গ্রামীণ অর্থনীতি, প্রান্তিক কৃষক, মেহনতি শ্রমিক, অবহেলিত যুবক ও নারী যাদের জন্য রাজনীতি অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক মর্যাদার লড়াই, তাদের কাছেই তিনি হয়ে উঠেছেন তৃণমূল প্রান্তিক মানুষের রাজনীতির প্রতীক।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি বিপুল বিজয় লাভ করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সাফল্যের পেছনে তারেক রহমানের সাংগঠনিক দক্ষতা এবং তরুণদের সম্পৃক্ত করার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তিনি গ্রামে গ্রামে বিএনপিকে সক্রিয় করেন, নতুন নেতৃত্ব সামনে নিয়ে আসেন এবং প্রচারণায় আধুনিক কৌশল প্রয়োগ করেন। তাঁর এই ভুমিকা বিএনপিকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
২০০৭ সালের ১/১১ এর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মিথ্যা মামলা, কারাগারের অমানবিক পরিবেশ ও শারীরিক নির্যাতনে তিনি প্রায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে বাধ্য হন। সেই থেকে প্রায় ১৭ বছর ধরে তিনি দেশের বাইরে। প্রবাস জীবনে থেকেও তিনি রাজনীতি ছাড়েননি, বরং দলকে নতুনভাবে সংগঠিত করার চেষ্টায় অবিচল থেকেছেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে বিএনপির ওপর নেমে আসে ব্যাপক দমন-পীড়ন।বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ছিলেন আওয়ামী শিবিরের প্রধান প্রতিপক্ষ। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক হেন কোন ষড়যন্ত্র, অপমান নেই যার সম্মুখীন তারা হননি। এত কিছুর পর তারেক রহমান প্রবাস থেকে বিএনপির কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে, খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকায় কার্যত পুরো দলের নেতৃত্ব ছিল তাঁর ওপর। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ছাত্র-যুব আন্দোলনেও তিনি নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে ওঠেন। আন্দোলনকারীরা তাঁর দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে সংগঠিত হয়। সরাসরি দেশে না থেকেও তাঁর নির্দেশনা ও দিকনির্দেশনাকে কেন্দ্র করেই আন্দোলন সংগঠিত হয়। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রবাস জীবন থেকেও একটি দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা সম্ভব।
জনাব তারেক রহমানের অনন্যতা বোঝার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, দীর্ঘ সময় ধরে একদলীয় শাসন ও দমননীতির কারণে দেশে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সেই শূন্যতায় বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে জনগণের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নাম হয়ে উঠেছেন তিনি। দ্বিতীয়ত, তিনি বহন করছেন একটি ঐতিহাসিক ও মর্যাদাপূর্ণ রাজনৈতিক উত্তরাধিকার শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকার। এ কারণে জনগণ তাঁকে কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নয়, বরং পরিবারের ধারাবাহিক সংগ্রামের প্রতীক হিসেবেও দেখে।
তৃতীয়ত, তাঁর জীবন সংগ্রাম ও ত্যাগে পূর্ণ। একের পর এক মিথ্যা মামলা, নির্বাসন, দমন-পীড়ন সত্ত্বেও তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াননি। এই দৃঢ়তা ও আত্মত্যাগই তাঁকে জনগণের কাছে প্রকৃত নায়ক করে তুলেছে। চতুর্থত, যুবসমাজের কাছে তিনি এক অনুপ্রেরণা। সংগঠন পরিচালনায় প্রযুক্তির ব্যবহার, তথ্যভিত্তিক রাজনীতি এবং তরুণ নেতৃত্ব তৈরির উদ্যোগ তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। সর্বশেষ, প্রবাস জীবনেও তিনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। প্রায় দুই দশক ধরে দেশের বাইরে থেকেও তিনি বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন এবং নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান শুধু আবেগ নয়, বাস্তব প্রেক্ষাপটেও তাঁকে অনন্য করে তুলেছে।
জনাব তারেক রহমানের সংগ্রামী জীবন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। তিনি পিতৃহারা হয়েছেন, নির্বাসনে থেকেছেন, মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়েছেন, কিন্তু জনগণের হৃদয় থেকে মুছে যাননি। বরং তিনি আজ কোটি মানুষের আশার প্রতীক।
যখন বাংলাদেশ নতুন দিগন্তের দিকে এগোচ্ছে, তখন জনগণ অপেক্ষা করছে একদিন তিনি নিজ দেশে ফিরে এসে নেতৃত্ব দেবেন, পূর্ণ করবেন শহীদ জিয়ার স্বপ্ন ও গণতন্ত্রের লড়াই। তাঁর সংগ্রামী জীবন শুধু অতীতের কাহিনি নয়, বরং ভবিষ্যতের দিশারি।
ডাঃ এ, কে, এম আহসান হাবীব
চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক