জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে ঋণের বড় বোঝা বইতে হচ্ছে, এমন দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে। শনিবার ঢাকায় প্রকাশিত জলবায়ু ঋণ ঝুঁকি সূচক (২০২৫) শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ গতকাল শনিবার এ সূচকটি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশের জন্য দায়ী হলেও বর্তমানে দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু জলবায়ু ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার, যার পরিমাণ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
গবেষণায় উঠে এসেছে, প্যারিস চুক্তির ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিশ্রুত আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন ব্যবস্থাটি কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য একটি ‘জলবায়ু ঋণ ফাঁদে’ পরিণত হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু অর্থায়নের ৭০ শতাংর্শেও বেশি আসে ঋণ হিসেবে, যা সংকটাপন্ন দেশগুলোকে দ্বিগুণ ক্ষতির মুখে ফেলছে। প্রথমত: দেশগুলো উপর্যপুরি জলবায়ু ঘটিত বিপর্যয়ের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একইসঙ্গে ঋণের ক্রমবর্ধমান কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। শুধু ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার। এখানে ১৩ কোটির বেশি মানুষ কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে বাস্তুচ্যূত হয়েছে। অন্যদিকে, পরিবারগুলো স্ব-অর্থায়নে জলবায়ু ঘটিত বিপর্যয় থেকে থেকে সুরক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রতি বছর মাথাপিছু গড়ে ১০ হাজার ৭০০ টাকা (প্রায় ৮৮ মার্কিন ডলার) ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে, যা জাতীয় পর্যায়ে বছরে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ঐকমত্য অনুযায়ী বেশি দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা দেশের ক্ষতির দায়্ও বেশি ন্ওেয়ার কথা। কিন্তু এই নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের মাধ্যমে প্রতি টন কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের জন্য বাংলাদেশকে ২৯ দশমিক ৫২ মার্কিন ডলার ঋণ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে জলবায়ু অর্থায়নের অর্ধেকেরও বেশি ব্যবহৃত হয় জ্বালানি খাতে, যা মূলত ঋণনির্ভর। অন্যদিকে, অভিযোজনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হ্ওয়া সত্ত্ব্ওে পানি সরবরাহ খাতে ঋণ মেলে কম। আর ঝুঁকি ও প্রয়োজনের তুলনায় কৃষি, দুর্যোগ প্রস্তুতি, স্বাস্থ্য ও শিল্প খাতে জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ মেলে বেশ কম।
অর্থায়নের নামে প্রতারণার দিকটিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। বলা হচ্ছে, দেশের জলবায়ু অর্থায়ন ব্যবস্থা ঋণ নির্ভর, ধীরগতির ও জীবন রক্ষাকারী অভিযোজন কার্যক্রমের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। জলবায়ু অর্থায়নের প্রায় ১৯ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পে ভুলভাবে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। এমন প্রকল্পে ঋণের তুলনায় অনুদান অনেক কম হ্ওয়ায় দেশের সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
প্রতিবেদনে অভিযোজন খাতের কমপক্ষে ৭০ ভাগ ও ক্ষয়ক্ষতি খাতের পুরো অর্থায়ন অনুদান হিসেবে দেওয়া, শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ও ন্যায্য খাতে সহজ শর্তে ঋণ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এর বাইরে জলবায়ু সুরক্ষার বিনিময়ে ঋণ ম্ওকুফ কার্যক্রম বাড়াতে তাগিদ দ্ওেয়া হয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. এ কে ইনামুল হক অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, সীমিত অনুদান, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ ও বেসরকারি খাতে অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশকে গভীর ঝুঁকিতে ফেলছে। তিনি খন্ড খন্ড সমাধানের পরিবর্তে স্থানীয় জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তৈরি হওয়া ঝুঁকি সামগ্রিকভিত্তিতে মোকাবিলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, দৃঢ় অঙ্গীকার ও স্পষ্ট শাসনব্যবস্থা গড়ে না তুললে ২৯তম জলবায়ু সম্মেলনে ঘোষিত শত কোটি ডলারের তহবিল ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর কাজে আসবে না।
পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ ও পিকেএসএফ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ফজলে রাব্বি সাদেক আহমেদসহ অন্য অনেকে আলোচনায় অংশ নেন।