খান আরিফুজ্জামান নয়ন, ডুমুরিয়া।।
খুলনার ডুমুরিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিলাম না করে বিদ্যালয়ের ভবন এবং আসবাবপত্র বিক্রয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও সরকারি বরাদ্দের অর্থ আত্মাসাৎ এবং ভর্তি বানিজ্যসহ স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে প্রধান শিক্ষক সালমা রহমান এবং শিক্ষক রতন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা এসকল অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতা থেকে পরিত্রান পেতে চান এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার দাবী জানান। অভিযোগ রয়েছে, প্রধান শিক্ষক স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কিন্তু বর্তমানে তার কর্ম অবহেলা এবং অনিয়মের কারনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বিদ্যালয়ের অন্যান্যরা এবং অভিভাবকরা। বিদ্যালয়ের সরকারি বরাদ্দের অর্থ ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে আত্মাসাৎ করা হচ্ছে। এছাড়াও দীর্ঘদিন যাবৎ ভর্তি বানিজ্য হচ্ছে বিদ্যালয়টিতে। এ নিয়ে ডুমুরিয়ার সাধারন মানুষরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। শুধু প্রধান শিক্ষক নন। প্রধান শিক্ষককে একই বিদ্যালয়ের শিক্ষক রতন বিশ্বাস নানান অনিয়মে সহযোগিতা করেন। সম্প্রতি বিদ্যালয়ের মাঠের পশ্চিম দিকে একটি বিজ্ঞান ভবন এবং একটি টিনশেড বিল্ডিং প্রধান শিক্ষক সালমা রহমান এবং শিক্ষক রতন বিশ্বাস কোনরূপ নিলাম ছাড়া গোপনে বিক্রয় করেছেন। কিন্তু নিয়ম বিধি মোতাবেক ভবন দুটি কোনরুপ টেন্ডার ছাড়া বিক্রয় যোগ্য নয়। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিক্রয়কৃত বিজ্ঞান ভবনটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। ভবনটি সম্পূর্ন ব্যবহার উপযোগী ছিলো।
বিজ্ঞান ভবনের একটি রুমে পদার্থ বিজ্ঞানের ক্লাস ও অন্য রুমে রসায়ন ও জীব বিজ্ঞানের ক্লাস করানো হতো। অন্যদিকে, টিনশেড বিল্ডিংয়ের টিনের ওপরে হালকা মরিচা পড়েছিল এবং দেওয়ালে রং উঠে গিয়েছিল। যার কারণে ওই কক্ষ রুমে ক্লাস নেয়া হতো না। টিনশেড বিল্ডিং ভবনের কক্ষ দুটির একটিতে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সরকারি বই রাখার জন্য ব্যবহার করতো। অন্য কক্ষটি মেয়েদের কমন রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নিলাম ছাড়া বিক্রয় করা ভবন দুটির রড ও গ্রিলের বাজার মূল্য প্রায় লক্ষ্য টাকার অধিক। গ্রিল, কলাপসিবল গেট এবং কাঁঠের দরজা উন্নত মানের ছিলো। বিজ্ঞান ভবনের সাথে স্থায়ীভাবে বসানো কাঠের আলমারি এবং টেবিল ছিল। এসকল টেবিলে ব্যবহারিক ক্লাসের রাসায়নিক দ্রব্য রাখা হতো। ব্যবহৃত আলমারি এবং তাকগুলো গোপনে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রাপ্ত অর্থ রাজস্ব খাতে জমা না করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। স্কুলের বর্তমান মেইন গেটের স্থলে একটি লোহার গেট ছিলো। সেই লোহার গেট বিক্রয় করেও অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। স্কুলে নির্মানাধীন ছয়তলা ভবনের জায়গায় দুটি নারকেল গাছ, চারটি মেহগিনি গাছ, একটি বহুবর্ষী শিরিষ গাছ এবং কয়েকটি আমগাছ ছিলো। এ সকল গাছ কোনো টেন্ডার ছাড়া বিক্রয় করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের গাছ বিক্রয় বাবদ প্রাপ্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
অন্য একটি অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ডুমুরিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সালমা রহমান ১৯৮৮ সাল থেকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এবং পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এই স্কুলে কর্মরত রয়েছেন। দীর্ঘদিন স্কুলে কর্মরত কারনে তিনি স্বেচ্ছাচারিতা এবং অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। যা নিয়ে বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে তৈরী হয়েছে অনাস্থা। স্কুলের সরকারি বরাদ্দের অর্থে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় না করে নকল ভাউচার করে বরাদ্দের টাকা উত্তোলোন করা হয়েছে। স্কুলের ল্যাপটপ এবং দামি দূরবীন যন্ত্র প্রধান শিক্ষক এবং রতন বাবু নিজ বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন। রতন বাবু ২০১৭ সাল থেকে এই স্কুলে কর্মরত আছেন। এছাড়াও ভর্তি বাণিজ্য, ফরম বিক্রির টাকা নিয়ম অনুযায়ী ৫০% শিক্ষক কর্মচারীর মধ্যে ভাগ করে দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা কাউকে দেয়া হয়না। স্কুলের প্রশাসনিক কার্যক্রম সরকারি নিয়মে পরিচালিত হয় না। শিক্ষক রতন বিশ্বাস বিদ্যালয়ে না পড়িয়ে নিজের বাসায় কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করেন এবং শিক্ষার্থীদের তার কোচিং সেন্টারে পড়ার জন্য নানান কৌশলে চাঁপ প্রয়োগ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ে এখন কোন প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মনীতি নেই। একচ্ছত্র স্বেচ্ছাচারিতায় চলছে বিদ্যালয়। গুটি কয়েক লোকের মাধ্যমে কোন জবাবদিহিতা ছাড়াই বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। ভর্তি বানিজ্যের কারনে বিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ভর্তি বানিজ্যের কারনে এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও প্রায়ই বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ নিয়ে বিদ্যালয়ে গন্ডগোল লেগেই থাকে। আমরা সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিতের জন্য বিদ্যালয়ে পাঠাই কিন্তু এ ধরনের সমস্যা লেগে থাকলে বিদ্যালয়ের সঠিক পাঠদান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বললে , একটা প্রসেস করে বিল্ডিং ভাঙ্গা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। শিক্ষক রতন বিশ্বাস এসকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রধান শিক্ষক সালমা রহমানও কৌশলে এসব বিষয়ে অভিযোগ অস্বীকার করে এড়িয়ে যান।
নিয়মানুযায়ী প্রধান শিক্ষক বেসরকারি বিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডের ডিজি প্রতিনিধি থাকেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিয়োগ বোর্ডে রতন বাবুই মূলত নিয়োগ বাণিজ্য পরিচালনা করে যাচ্ছেন। প্রধান শিক্ষক প্রতিটা নিয়োগ বোর্ডে ঠুঁটো জগন্নাথের মত নীরব বসে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। বিদ্যালয়ের জুনিয়র শিক্ষকদের রতন বাবু প্রায়ই বিভিন্নভাবে হুমকি -ধামকি দিয়ে থকেন। এবং বিদ্যালয়ের অফিস স্টাফদের সাথে প্রায়ই বিরুপ আচরণ করে থাকেন। বিভিন্ন ধরণের শিক্ষক প্রশিক্ষণে নিজের নাম এবং দু একজন পছন্দের শিক্ষকের নাম পাঠিয়ে থাকেন বলে জানা যায়। প্রশিক্ষণ থেকে যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নাম বাদ দেওয়ারও নজির আছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জনাব দেবাশীষ বাবুর সহায়তায় তিনি এ কাজগুলো সম্পন্ন করেন।রতন বাবু সাবেক ভুমি মন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ায় সাবেক প্রভাবশালী এই মন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে প্রধান শিক্ষকের প্রত্যক্ষ সহায়তায় তিনি এরকম অনেক অনৈতিক কাজের সাথে জড়িয়ে এসকল কাজ করতেন। বিদ্যালয়ের ওখঈ ল্যাবের দায়িত্বে রতন বাবু থাকলেও শিক্ষার্থীদের মাঝে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, তিনি কখনও ল্যাবে ক্লাস নেন না। প্রায়ই ল্যাবে ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকে।
তিনি প্রায়শই বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজে ও করণিক কাজেই ব্যস্ত থাকেন। বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্ন প্রধান শিক্ষকের নিয়ন্ত্রণে অন লাইন থেকে বের করার কথা থাকলেও রতন বাবু এ কাজটিও করে থাকেন। একাধারে নিজ বাসায় কোচিং বাণিজ্য পরিচালনা করা একজন শিক্ষক কিভাবে বোর্ড প্রশ্নের গোপনীয়তারক্ষা করেন সেটিও নিঃসন্দেহে প্রশ্ন সৃষ্টি করে। বিদ্যালয়ের দক্ষিণপার্শ্বে একটি পুকুর আছে। পূর্বে এ মাছ শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হলেও বিগত কয়েক বছর ধরে এ মাছগুলো শুক্রবার জুম্মার নামাজ চলাকালীন সময়ে জনাব রতন বাবু প্রধান শিক্ষকের যোগসাজশে মেরে নিয়ে যান বলে জানা যায়।০৮.২০২২-২৩ অর্থবছরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ১,০০০০০/-এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। পুরো টাকাটি তুলে প্রধান শিক্ষক ও রতন বাবু আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা গেছে।বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা কমিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও প্রধান শিক্ষক এটিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ন্যায় রতন বাবু সর্বস্ব কমিটি করে রেখেছেন। অথচ অনেক যোগ্য শিক্ষক বছরের পর বছর চাকরি করেও কমিটিতে থাকতে পারছেন না। এ সব কিছু সম্পন্ন হয় রতন বাবুর পরিকল্পনায় ও পরামর্শে।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ডুমুরিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি মুহাম্মদ আল-আমিন বলেন, আমি ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে যোগদানের পর এ ধরনের কাজ বিদ্যালয়ে হয়নি। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে নিয়ম অনুসারে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।