পঁচাত্তরের রক্ত প্লাবন–নাহিদ মাহমুদ সাকিব


সহ সম্পাদক প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৫, ২০২২, ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ /
পঁচাত্তরের রক্ত প্লাবন–নাহিদ মাহমুদ সাকিব
পঁচাত্তরের রক্ত প্লাবন--নাহিদ মাহমুদ সাকিব

আকাশ ভরা বেদনার নীলে ভর করে উঠেছিল সকালের সূর্যটা। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে, আচমকা বৃষ্টির মতো গুলি; গুলির শব্দ শুনে ঘুমভাঙা চোখে নিচে নেমে এলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল। তাকে দেখে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা স্টেনগান চালায়, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তার বুক। কুলাঙ্গার দল বাড়ির ভিতরে ঢুকে দোতলায় ওঠার সময় বঙ্গবন্ধুর দেখা পায় সিঁড়িতে, মুজিব দাঁড়িয়ে আছেন পাইপ হাতে। অবিচল অকুতোভয় মুজিবকে দেখে খুনি মহিউদ্দিন থেমে গেলে তাকে সরতে বলে বজলুল হুদা ও নুর চৌধুরী স্টেনগান চালায়। সিঁড়িতেই লুটিয়ে পরেন স্বাধীন বাংলার কারিগর, তখন ভোর ৫ টা ৪০ মিনিট। সেই বিখ্যাত তর্জনী রক্তে রক্তাক্ত হলো ঐ কুলাঙ্গারদের বুলেটে। যার রণমন্ত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেই মানুষটির পূণ্যরক্ত প্লাবনের সাক্ষী হয়ে রইলো শ্রাবণের কলঙ্কিত রাতের নিষ্ঠুরতম শেষ প্রহরটি। বাংলার গৌরব রবি গেলো অস্তাচলে।

আজিজ পাশা ও মোসলে উদ্দিন শোবার ঘরে গিয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ জামাল, সদ্য বিবাহিতা রোজী জামাল ও সুলতানা কামালকে স্টেনগানের গুলিতে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই শেখ নাসের মৃত্যুর আগে ঘাতকদের কাছে একটু পানি চেয়েছিলেন, পানির বদলে জোটে ব্রাশফায়ার। ঘাতকদল শিশু রাসেলকে বসিয়ে রেখেছিল গেটের পাশে পাহারাদারের চৌকিতে, রাসেল মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদছিল। আজিজ পাশা একজন হাবিলদারকে হুকুম দেয় রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে, সেই হাবিলদার উপরে নিয়ে গিয়ে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে শিশু রাসেলকে। প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা করে রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর ১৪ বছরের কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, ১০ বছরের পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, চার বছর বয়সী নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাতিজা সজীব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে নান্টু, তিনজন অতিথি ও দুইজন গৃহকর্মীকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্ণেল জামিল খবর পেয়ে ছুটে আসার সময় সোবহানবাগ মসজিদের কাছে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে খন্দকার মোশতাক রেডিওতে নিজেকে ঘোষণা করলেন রাষ্ট্রপতি আর খুনীদের সূর্য সন্তান।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড ঘটাতে যাওয়ার আগে সিপাহীদের এই বলে উদ্বুদ্ধ করা হয় যে, এই বিদ্রোহের পর দেশে ইসলামিক শাসনতন্ত্র কায়েম করা হবে। অথচ বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী, ৩ ছেলে এবং ২ পুত্রবধূকে বনানী গোরস্থানে দাফন করা হয় রক্তাক্ত কাপড়েই। ঘাতক-চক্র সেখানে কোন জানাজা কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে দেয়নি কাউকেই। বরং কার কবর কোনটা, সেটাও চিহ্নিত করে রাখেনি তারা।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে কোথায় কবর দেয়া হবে, এই নিয়ে খুনীদের সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় এক দিন আর এক রাত লেগে যায়। মুজিবকেও তারা বনানীতে কবর দিতে চেয়ছিল। কিন্তু এখানে জাতির পিতার লাশ দাফন করলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে এমন আশংকা করে তারা। এ প্রসঙ্গে কে এম শফিউল্লাহর ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গ’- গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর কবর, জানাজা নিয়ে প্রথম চিন্তা করেন মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। তিনি তখন বঙ্গভবনে অনেকটা বন্দী অবস্থায় ছিলেন।  তিনি খন্দকার মোশতাককে বঙ্গবন্ধুর দাফন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, সেই বিশ্বাসঘাতক বলেন, ‘রাস্তাঘাটে তো কতো মানুষ মারা যায়, তাদের সবার দিকে দিকে কি আমার খেয়াল রাখতে হবে? গ্রেভ হিম এনিহোয়ার, বাট নট ইন ঢাকা।’

তখন তিনি ও এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার ঠিক করেন যে বঙ্গবন্ধুকে তার বাবা মায়ের পাশে শায়িত করা হবে। এ কাজটি করতে খালেদ মোশারফকে তিনি ব্যাবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।

রাজধানী থেকে বহুদূরে এক শান্ত শ্যামল গ্রাম টুঙ্গিপাড়া, জীবিত বঙ্গবন্ধু শেষ কবে এসেছিলেন কেউ বলতে না পারলেও গুলিবিদ্ধ রক্তমাখা ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহের বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন ১৬ই আগস্ট। হত্যাযজ্ঞের পরেরদিন একজন মেজর, একজন লেফটেন্যান্ট ও কিছু সৈন্যসহ মুজিবের লাশ হেলিকপ্টারযোগে টুঙ্গিপাড়া পাঠানো হয়। তারা গ্রামের পেশ ইমামকে ডেকে পাঠায় এবং জিজ্ঞাসা করে গ্রামের লোকজন কি শেখ মুজিবের লাশ দাফন করতে চায় কি না? তারা উত্তর দেয়, যদি মরদেহ তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় তবে তারা দাফন করতে রাজি আছে। গ্রামবাসীদের বলা হয়, তাদেরকে মুজিবের কবর ছাড়াও আরো ১০-১২টি কবর খুঁড়তে হতে পারে, কিন্তু আপাতত একটি কবর রেডি করতে হবে। 

কফিন খুলতে কাঠমিস্ত্রি ডাকতে হলো। কফিন খুললেন কাঠমিস্ত্রি আইয়ুব আলী। তার ভাষায় বঙ্গবন্ধুর মুখটি মলিন হয়নি তখনো, কিন্তু দেহ ছিল বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত এবং বরফ ভরা কফিনটি ছিল রক্তস্নাত। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে কফিনটি ঘিরে দাঁড়িয়েছিল কয়েকজন। প্রতি মুহূর্তেই আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে শতশত মানুষ ভিড় করছিল। তাদেরকে লাশের সামনে পৌঁছতে বাধা দেওয়া হলো। দাফনের কাজ যারা করছিল তাদের কয়েকজন ছাড়া কাউকেই দেখতে দেয়া হলনা পিতার মুখ। জীবনের বেশিরভাগ সময় যে মানুষটি কাটিয়েছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে, মৃত্যুর পর তাঁকেই রাখা হলো তাঁর প্রিয় জনগণের কাছ থেকে দূরে।

উপরের নির্দেশের দোহাই দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জানাজার আগে লাশের গোসল করানোর সুযোগটিও দিতে চায়নি কুলাঙ্গাররা। কিন্তু মৌলভী শেখ আব্দুল হালিম বলেছিলেন লাশের জানাজা গোসলের আগে হতে পারেনা। একটি ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল কারানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে, পরানো হয়েছিল তারই বিতরণ করা রিলিফের কাপড়। যে নেতার জন্য বাংলাদেশ পেয়েছি, যে নেতা ৪৬৮২ দিন জেলে কাটিয়েছেন এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর জানাজায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল মাত্র ২৫-৩০ জনকে। কিন্তু কেঁদেছিল সমস্ত বাংলা, হতাশায় ভুগছিল সমগ্র বিশ্ব।

নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট বলেছিলেন, “মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে’’।

অপরদিকে মেজর জিয়া ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে রূপান্তর করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই থামেনি জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে আসতে দেয়া হয়নি। বিদেশে শুরু হয় তাঁদের নির্বাসিত জীবন। ভারত তাঁদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। ১৯৮১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেজর জিয়া ভারতের চাপের মুখে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ঢুকতে দিলেও ৩২ নম্বরের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৃত স্বজন ও দেশবাসীর জন্য দোয়া মোনাজাত করেন।

পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশকে অনেক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সাক্ষী হতে হয়। ক্ষমতার পালাবদলে এদেশে পাকিস্তানী দোসররাও সরকার গঠনের সুযোগ পায়। রাজকারদের গাড়িতে ওড়ে স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা। বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে চলে ইতিহাস বিকৃতির উৎসব। কিন্তু অপচেষ্টাকারীরা জানে না যে, ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে কিন্তু আদর্শের কোন মৃত্যু নেই।

লেখকঃনাহিদ মাহমুদ সাকিব 

সাবেক উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ,পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়