প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি হলে জীবিকার তাগিদে বিপাকে পড়েন ভোলার ক্ষুদ্র জেলেরা। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং ঋণনির্ভর জীবনের চাপে অনেকেই বাধ্য হয়ে অবৈধ বা নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করছেন বলে জানানো হয়েছে কোস্ট ফাউন্ডেশনের এক সাম্প্রতিক গবেষণায়।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ জেলে পরিবার নিষেধাজ্ঞার সময়ও মাছ ধরতে এসব জাল ব্যবহার করেন। অথচ তাঁদের ৯৩ শতাংশ জানেন, এই জাল নদী ও সাগরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে এবং মাছের প্রজনন ও উৎপাদন হ্রাস ঘটায়।
জীবিকা টিকিয়ে রাখতে এসব জেলে কারেন্ট, মশারি, প্লাস্টিক, বিন্দি, ঠেলা ও খুটা জালের মতো অবৈধ সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন। এতে সামান্য কিছু মাছ ধরা পড়লেও নির্বিচারে মারা যাচ্ছে অগণিত পোনা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শৈবাল, ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্য।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের গবেষণাটি ২০২৪ ও ২০২৫ সালের তথ্য ও মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এতে ভোলার ক্ষুদ্র জেলেদের বাস্তব চিত্র, প্রশাসনিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গে তাদের সংযোগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
সোমবার (১৩ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী ও সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা।
সংস্থাটি জানায়, নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও ক্ষুদ্র জেলেদের জীবিকা সুরক্ষায় কার্যকর সহায়তা কাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি। টেকসই উন্নয়ন ও ন্যায্য অর্থনৈতিক কাঠামোর বাইরে থাকা এই সম্প্রদায়কে বিকল্প আয়ের সুযোগ না দিলে অবৈধ মাছ ধরার প্রবণতা বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করে সংস্থাটি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ভোলা জেলার নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৮১ হাজার পরিবার এখনো সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত। ইউনিয়নভিত্তিক তথ্য অনুসারে, সরকারি হিসাবের বাইরে অন্তত আরও ২০ হাজার ক্ষুদ্র জেলে পরিবার রয়েছেন। কেবল ভোলা সদর উপজেলায় প্রকৃত ক্ষুদ্র জেলে পরিবারের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ৫৫ শতাংশের জেলে কার্ড রয়েছে।
তবে এই কার্ডধারী পরিবারগুলোর মধ্যেও নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারি সহায়তা পান কেবল ৪৪ শতাংশ। ফলে জেলার সামগ্রিক চিত্রে দেখা যায়, ভোলার ক্ষুদ্র জেলেদের মধ্যে সহায়তা পাওয়ার হার ২৪ শতাংশের নিচে। এ ছাড়া ২০২৫ সালের জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৮৩ শতাংশ জেলে পরিবার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ১–২ মাস পর সরকারি চাল সহায়তা পেয়েছেন, যা কার্যক্রমের অদক্ষতা নির্দেশ করে।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, এই সময়ে ৮৭ শতাংশ জেলে পরিবারের আয় প্রায় শূন্যে নেমে আসে- যেখানে স্বাভাবিক সময়ে তাদের মাসিক আয় থাকে ১০–১৫ হাজার টাকা। আয়ের এই পতন থেকে পারিবারিক অস্থিরতা, এমনকি নারী নির্যাতনের ঘটনাও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়।
কোস্টের জরিপ অনুযায়ী, ৮৭ শতাংশ পরিবার কখনো কোনো প্রশিক্ষণ বা বিকল্প আয়ের উপকরণ পাননি, মাত্র ৫ শতাংশ পরিবার অন্য পেশায় যুক্ত হতে পেরেছেন। ফলে অধিকাংশই দাদনদারদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। ৬৫ শতাংশ জেলে পরিবার ঋণ শোধে আবারও নতুন ঋণ গ্রহণ করে, যা এক অনন্ত ঋণচক্রে তাদের আটকে রাখছে। এই ঋণনির্ভরতা শেষ পর্যন্ত তাদের অবৈধ জাল ব্যবহার বা আগাম মাছ বিক্রির মতো অনৈতিক চুক্তিতে ঠেলে দিচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে কোস্ট ফাউন্ডেশন ক্ষুদ্র জেলেদের টেকসই উন্নয়ন ও জীবিকা সুরক্ষায় নয় দফা দাবি উপস্থাপন করে।
কোস্ট ফাউন্ডেশনের নয় দফা দাবি:
১. প্রকৃত জেলেদের অন্তর্ভুক্ত করে ইউনিয়নভিত্তিক তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
২. নিষেধাজ্ঞাকালে প্রতি জেলে পরিবারকে মাসে কমপক্ষে ৮,০০০ টাকা নগদ ও ৪০ কেজি চাল দিতে হবে।
৩. সহায়তা দিতে হবে নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার ১৫ দিন আগে; দেরি রোধে ডিজিটাল ট্র্যাকিং চালু করতে হবে।
৪. ক্ষুদ্র জেলেদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক লোন বা ক্রেডিট সুবিধা সহজ করতে হবে।
৫. নারী ও তরুণ সদস্যদের জন্য পশুপালন, হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তা দিতে হবে।
৬. ঋণনির্ভরতা কমাতে প্রণোদনা ও সহায়ক তহবিল গঠন করতে হবে; দাদনদার নির্ভর ঋণের পরিবর্তে স্বল্পসুদে সমবায়ভিত্তিক ঋণ ও অনুদান স্কিম চালু করতে হবে।
৭. নিষিদ্ধ জালের উৎপাদন ও ব্যবহার রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং কারখানাগুলোর ওপর প্রশাসনিক নজরদারি জোরদার করতে হবে।
৮. Blue Economy, WTO ও COP30 নীতি-আলোচনায় ক্ষুদ্র জেলেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের জন্য ‘Just Transition Fund’ গঠন করতে হবে।
৯. মান্দা সম্প্রদায়কে অবিলম্বে জেলে কার্ডের আওতায় আনতে হবে।
    