
আমার বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। তার মানে খুব বেশি সময় আগে আমার শৈশব-কৈশোরকে ফেলে রেখে আসিনি। এইতো সেদিনের কথা। এখনও আমার শৈশব-কৈশোরকে ভীষণ মনে পড়ে। আর মনে পড়ে শৈশব-কৈশোরে আমি আমার বাবাকে কেমন দেখেছি।
আমার একজন কৃষক। কৃষি কাজের পাশাপাশি বাবা ছিল মেকানিক, মানে কৃষিজমিতে ব্যবহৃত শ্যালো ইঞ্জিন মেরামত করত। বেশ সম্মানজনক পেশা ও ভালো আয়ের উৎস ছিল সেসময়। আমার বাবা বেশ স্বচ্ছল ছিল তখন। পেশাগত কাজের পাশাপাশি আমার বাবা রাজনীতিতে বেশ স্বকীয় ছিল। সেই সময়ের এম.পি., উপজেলা চেয়ারম্যানসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির সান্নিধ্য আমি পেয়েছি শুধুমাত্র বাবার কারণেই। নেতাদের সাথে সেই ছোট্ট বয়সেই হ্যান্ডসেক করেছি, মঞ্চে উঠেও বসে থেকেছি নেতাদের পাশে। আমার বাবা স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিল, মসজিদ কমিটিরও দায়িত্বে থাকত। স্কুল-মসজিদের দায়িত্বগুলো আমার বাবার কাঁধে আসে ১৯৯৯ সালে আমার দাদা স্ট্রোক করে মারা যাওয়ার পর থেকে। ২০০০-এর দশকে কৃষি জমিতে ভালো ফলন ও দাম থাকায়, গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি লালন-পালন করায় আমাদের পরিবারের অবস্থা ছিল অনেক অনেক ভালো। সেসময় বাবার থেকে টাকা নিয়েই শুধু নয়, পরনে পায়ের জুতা, গায়ের জামা নিয়েও অনেকে ঢাকা এসে চাকরি নিয়েছে। কিন্তু আমার বাবা আসেনি। বাবা প্রচুর মানুষকে টাকা ধার দিয়েছে, মেকানিকের কাজও শিখিয়েছি মানুষকে। স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি দিয়েছে। আর আমার দাদা তো এলাকায় অনার্স পাস যুবক পেলেই টেনে এনে স্কুলে চাকরি দিতেন। সেই গুণই পেয়েছিল আমার বাবা। সবমিলিয়ে, আমার বাবাকে দশ গ্রামের মানুষ চিনত, সম্মানও করত।
এতক্ষণ যা লিখেছি, ক্রিয়ার ব্যবহার করেছি অতীতকালের। মনে হতে পারে, আমার বাবা আর নেই। না, আমার বাবা জীবিত আছে। কিন্তু ২০১০-এর দশকের পর থেকে সবকিছু আর আগের মতো নেই। প্রথমত, কৃষিজ অবনতি। আগের মতো গোলাভরা ধান আর নেই। চাষাবাদও কমে এসেছে। কৃষিজমি চাষ করে কোনো লাভ হয় না। অসুস্থতার কারণে মেকানিকের পেশাও বাদ দিয়েছে এক দশক হল। রাজনীতিও আর করে না। সেই সময় ভালো চলাচল করায় কিছু মানুষ তো নেতিবাচক কথা বলতই। কিন্তু মিথ্যা কথা বাবা সহ্য করতে পারে না। তাই রাজনীতি থেকে যেমন দূরে সরে এসেছে, তেমনই স্কুল-মসজিদের দায়-দায়িত্ব থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। এখন এসব নষ্টদের দখলে আছে জেনেও বাবা চুপ করে থাকে। বয়স হয়েছে পঞ্চান্ন বছরের মতো। এখন শুধু আমাদের নিয়ে ভাবে, গোলার ধান বেচে ছেলেদের মানুষ করতে শহরে পাঠিয়েছি, তারা যেন সুখে থাকে, ভালো কর্মের সুযোগ পায়।
যেকোনো পরিবারের বাবার অবদান অনস্বীকার্য। আসলে তাদের অবদানের কথা কোনো ছেলেই কখনও ভুলতে পারবে না, আর ঋণ পরিশোধের তো কোনো প্রশ্নই আসে না। বাবার ঋণ কি কখনও শোধ করতে পারবে কোনো ছেলে? আমি তো পারব না। বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে আইসক্রিম কিনে খেয়েছি, স্কুলে যাওয়ার সময় টাকার জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরে না পেলেও বাবা ঠিকই দিয়েছে, হাট-বাজারে গেলে বাবা জিলাপি, খুরমা, বাতাসা, পাউরুটি না এনে থাকত না। সারা জীবন আয় করেও তো এইসবের দাম আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। আর পড়াশোনার বিষয়ে বাবা যে পরিমাণ তাগিদ দিয়েছে, সে কথা বলতে গেলে আরও লিখতে হবে। বাবার অনুপ্রেরণাতেই আমি বছর বছর ফার্স্ট হতাম। বাবার পরিশ্রমের টাকাতেই শুধু না, স্বদিচ্ছায়, যেন ভালো থাকি সে প্রত্যাশায় শহরে পাঠিয়েছে।
বাবাকে নিয়ে অগোছালোভাবে মনের কথাগুলো বললাম এজন্যই যে আজ বাবা দিবস। কিন্তু বাবাকে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে দিবস লাগে না। বাবাকে সবসময়ই ভালোবাসি। আমি চাই, সব সন্তানই তার বাবাকে ভালোবাসুক, শ্রদ্ধা করুক, সম্মান করুক। বাবা দিবসে সকল বাবাকে জানাই সালাম ও শুভেচ্ছা।
মোহাম্মদ অংকন :: লেখক, কবি ও সাহিত্যিক