ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন বড় আমানতকারীরাও


বাংলাদেশ চিত্র প্রকাশের সময় : জুন ১৩, ২০২৪, ১১:০০ পূর্বাহ্ণ /
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন বড় আমানতকারীরাও
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন বড় আমানতকারীরাও

ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতদিন ছোট ও মধ্যম সারির আমানতকারীরা ব্যাংক ছেড়েছেন। তবে উদ্বেগের খবর হলোÑ এবার ব্যাংক ছাড়ছেন কোটিপতি আমানতকারীরাও। অথচ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে আমানতের সুদহার। অর্থাৎ একদিকে স্বল্প সুদে ব্যাংকে রাখা টাকার সুদ বাড়ছে, অন্যদিকে মানুষ টাকা তুলে নিচ্ছে কেবল অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে। ফলে মানুষের হাতে টাকার স্তূপ বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতিতে।

অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, বাজারে অর্থের সঞ্চালন বেশি থাকলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়, যা নিয়ন্ত্রণ করতে দীর্ঘ সময় ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক থেকে চেক ফেরত দেওয়ার মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। এমনকি গ্রাহকের আমানতের টাকা কয়েক কিস্তিতে দেওয়া হচ্ছে কয়েকটি ব্যাংক থেকে। অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। উল্টো অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংককে নীতি ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক একীভূতকরণ ভীতি। হাফ ডজন ব্যাংককে দুর্বল ঘোষণা করেছে খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন ছোট-বড় সব আমানতকারী। সার্বিক অবস্থায় পুরো ব্যাংক খাতে আস্থার সংকট প্রকট হয়েছে। ফলে এখন বড় আমানতকারীরাও টাকা তুলতে শুরু করেছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা রয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৮৯০টি। কোটি টাকার ওপর এসব ব্যাংক হিসাবে মোট জমা আছে ৭ লাখ ৪০ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা।

গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি টাকার বেশি আমানতের ব্যাংক হিসাব ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮টি। ওই সময় এসব ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৭ লাখ ৪১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা কমেছে ১ হাজার ১৮। একই সময়ে এসব হিসাবের বিপরীতে জমা টাকার পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৪৭ দশমিক ১০ শতাংশই জমা করেছেন কোটি টাকার হিসাবধারীরা।

বড় আমানতকারীরা টাকা তুলে নেওয়ার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থাৎ মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব বলছে, গত এক বছরে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ বাজারে সঞ্চালন হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের মার্চে দেশে ব্যাংক খাতের বাইরে বা মানুষের হাতে নগদ অর্থ ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। ঠিক এক বছর পর চলতি বছরের মার্চ শেষে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে নগদ অর্থ বেড়েছে ৬ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি নাগরিকদের হিসাব নয়। কেননা, অনেক ব্যক্তিই যেমন ব্যাংকে ১ কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখেন, তেমনি অনেক প্রতিষ্ঠানও তা করে। অর্থাৎ কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব বলতে যুগপৎ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের কথাই বলা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তারও কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।

এর ফলে দেশে প্রকৃত কোটিপতির সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। তাই কত মানুষের কোটি টাকা রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান মেলে না। তবে ব্যাংকে কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ কোটি ১ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯১ হাজার ৬২৩টিতে, যেখানে আমানত জমা ছিল ১ লাখ ৯৪ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। ৫ কোটি ১ টাকা থেকে ১০ কোটির ১২ হাজার ৪৪৬টি হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৮ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা।

এ ছাড়া ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা রয়েছে ৪ হাজার ৩৯৬টি, ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটির মধ্যে ১ হাজার ৯৬১টি, ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটির মধ্যে ১ হাজার ২২১টি এবং ২৫ কোটি থেকে ৩০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৮৭৫টি আমানতকারীর হিসাব। আর ৩০ কোটি থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৫০১টি এবং ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩৬০টি, ৪০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাবসংখ্যা ৬৮১টি। তা ছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা ১ হাজার ৮২৬টি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর হিসাব ছিল ১৫ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার ২২৭টি। এসব হিসাবের বিপরীতে আমানত জমা হয়েছে ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব ছিল মাত্র ৪৭টি, যা ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৫১৬টি। করোনা মহামারির শুরুতে ২০২০ সালের মার্চে এই সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫, যা বর্তমানে ১ লাখ সাড়ে ১৫ হাজার ৮৯০টিতে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আস্থার সংকটে ব্যক্তি আমানতকারীরা টাকা তুলে নিচ্ছেন এটা ঠিক। দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত হওয়ার পর স্বাভাবিক কারণেই ওই ব্যাংক থেকে মানুষ টাকা তুলেছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন।’ এটি খুই উদ্বেগের খবর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘হিসাব বন্ধ করে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলা মানে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া এবং উৎপাদন ব্যাহত হওয়া। এটি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং মূল্যস্ফীতিতে বড় চাপ তৈরি করবে।’

নগদ অর্থ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহে মানুষ ব্যাংকের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ নূরুল আমিন বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বৃদ্ধির কারণে মানুষের খরচ বেড়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যাংকের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে মানুষ। সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুললেও ব্যাংকে নতুন করে তেমন জমা দিচ্ছেন না। এতে ক্রমে বাড়ছে ব্যাংকবহির্ভূত টাকার পরিমাণ। এ ছাড়া মার্জারের খবরে ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছেন আমানতকারীরা। ফলে ব্যাংক থেকে মানুষ সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে।’

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশ। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস, সানেম, সিপিডি) বলছে, এই হার ১৫ শতাংশের ওপর। মূল্যস্ফীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে।