প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ভারত শেখ হাসিনাকে পুরোটা সময় ধরে সহযোগিতা করে আসছে এবং তারা এখনও আশা করছে যে, তিনি হয়তো বাংলাদেশে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসবেন।
সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে সাংবাদিক মেহেদি হাসানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
মেহেদি হাসান আলজাজিরার টকশো ‘হেড টু হেড’-এর উপস্থাপক এবং মিডিয়া কোম্পানি জেটিওর প্রতিষ্ঠাতা। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভায় যোগদানের ফাঁকে তিনি ড. ইউনূসের এই সাক্ষাৎকার নেন। জেটিওতে ৩৪ মিনিটের সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয়।
সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে মেহেদি হাসান জিজ্ঞেস করেন, শেখ হাসিনার দুই দশকের শাসনের অবসানের রাতে তিনি কেমন অনুভব করেছিলেন। ড. ইউনূস উত্তরে বলেন, আমি উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত এটি হয়েছে। এটি একটি অভূতপূর্ব খবর ছিল। তিনি আরও বলেন, মাঠে আন্দোলন বাড়ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবেন, তা কল্পনাও করিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি চলে গেছেন, যা উত্তেজনাকর খবর ছিল।
গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশিদের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, দুই ধরনের অনুভূতিই রয়েছে। হতাশাও রয়েছে, পাশাপাশি উত্তেজনাও। কারণ, কিছু একটা হচ্ছে। হতাশা আছে, কারণ মানুষের প্রত্যাশার জায়গাটি অনেক বড়; তারা সবকিছু এখনই চায়। তবে আমি এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখি।
শেখ হাসিনার প্রস্থানের পর ছাত্ররা তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বের জন্য আহ্বান জানায়-এ প্রসঙ্গে মেহেদি হাসান জানতে চান, বিষয়টি তাকে অবাক করেছে কিনা। ড. ইউনূস বলেন, বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে। আমি তাদের চিনতাম না। প্রথমে আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ছাত্ররা ব্যাখ্যা দিল, তারা আত্মত্যাগ করেছে, শিশুরা গুলি খেয়েছে। তারা বলল, আপনি যদি এড়িয়ে যান, তাহলে দেশের কী হবে? তাদের আত্মত্যাগ দেখে আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি।
শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত দেবে কিনা-এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ভারত যদি নিজে একা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে তারা হয়তো শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে যাবে। আর যদি কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়, যা ভারত উপেক্ষা করতে পারবে না, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে।
তিনি আরও যোগ করেন, ভারত শেখ হাসিনাকে পুরোটা সময় ধরে সহযোগিতা করে আসছে। তারা এখনও আশা করছে, তিনি হয়তো বাংলাদেশে পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে বিজয়ীর বেশে ফেরত আসবেন।
শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল সভা ও তার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে ড. ইউনূস উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কোনো বহিঃশক্তি তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত আসতে সহযোগিতা করবে-এমন সম্ভাবনা আছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা সব সময় উদ্বিগ্ন।
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনা সম্পর্কে তার আলোচনার বিস্তারিত জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, মোদিকে জানিয়েছি, আপনারা যদি তাঁকে রাখতে চান, রাখেন। আমি আপনাকে উপদেশ দিতে পারি না, তাঁর সঙ্গে কী করবেন। তবে তিনি যাতে আমাদের নিয়ে কথা না বলেন, সেটি নিশ্চিত করেন। মোদি জবাব দিয়েছেন, সামাজিক মাধ্যমকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সমালোচনা প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, আমরা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিনি, তাদের নিবন্ধনও বাতিল করিনি। শুধু তাদের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করেছি। এর অর্থ হলো, তারা কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তাদের দল এখনও রয়েছে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ভোট দিতে পারবেন, তারা বৈধ ভোটার। তবে আওয়ামী লীগের মার্কা সেখানে থাকবে না। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, রাজনৈতিক দলটির এ চরিত্র বিবেচনা করে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার অভিযোগ সম্পর্কে মেহেদি হাসান প্রশ্ন তোলেন। ড. ইউনূস একে 'মিথ্যা সংবাদ' আখ্যা দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক বিরাজমান। পারিবারিক সমস্যা, জমি-সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। এখন আপনি এটিকে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত বলতে পারেন না।
তিনি দাবি করেন, গণঅভ্যুত্থানের পর এ ধরনের সংঘাতের সংখ্যা বাড়েনি। ড. ইউনূস হিন্দু সম্প্রদায়কে বলেন, কোথাও গিয়ে এটি বলবেন না যে আমি হিন্দু; আমাকে সুরক্ষা দিন। বলবেন, আমি বাংলাদেশের নাগরিক। আমি রাষ্ট্রের সকল সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখি। নিজেদের একা করে ফেলবেন না।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী অপরাধ ও সহিংসতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, এটি একটি অভ্যুত্থান ছিল। সবকিছু ভেঙে পড়েছিল। সরকার ছিল না। গতকাল যারা আপনার ওপর গুলি চালাচ্ছিল, তারা শান্তিরক্ষী হিসেবে এখন আপনার সামনে কাজ করছে। আপনি জানেন না, সে কোন পক্ষের। যখন বিষয়গুলো স্থির হতে শুরু করেছে...। তিনি দাবি করেন, বর্তমানে অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্য সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, এগুলো সুন্দর কথা। যে কোনো মানুষ এটি বলতে পারে। এটি সাধারণ কথা। শান্তি ও ঐক্যবদ্ধ থাকা আমাদের অভিন্ন লক্ষ্য।
সেনাপ্রধানের সঙ্গে সম্পর্কের ফাটলের গুজব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি যা বলেছেন, সে বিষয়ে আমরা কোনো উত্তর দিতে পারব না। এখানে করিডোরের মতো কোনো বিষয় নেই। নির্বাচন তাঁর চিন্তার বিষয় নয়, এটি সরকারের চিন্তার বিষয়।
পদত্যাগের ইচ্ছা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ড. ইউনূস বলেন, আমি কিছুটা বিরক্ত ছিলাম। কারণ, কাজগুলো যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছে না। তবে তিনি নিশ্চিত করেন যে, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়া পর্যন্ত তিনি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্ব হস্তান্তরের পর তিনি অবসর নেবেন না বলেও জানান।
    