ভূমিহীন আশ্রয়ণ কেন্দ্রে স্বস্তির বদলে অস্বস্তিতে বাসিন্দারা

বাংলাদেশ চিত্র ডেস্ক

স্টাফ রিপোর্টার
ওপরে লাল টিন ও ইটের দেয়ালে সাদা রঙের দুই কামরার ঘর। সামনে ছোট্ট বারান্দা। থরে থরে সাজানো ঘরগুলো দূর থেকে ছবির মতো দেখায়। ঘরের ভেতরে রান্নাঘর, আছে শৌচাগার। মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেশের ৩০টি জেলা ভূমিহীন ঘোষণা করে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক প্রকল্প বলে বিবেচিত এসব ঘর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সরাসরি উপজেলা পর্যায়ে তদারকি করা হয়। কিন্তু ভালো নেই এসব ঘরের বাসিন্দারা। নানা অব্যবস্থাপনায় ইতিমধ্যে অনেকে ছেড়ে গেছেন বিনামূল্যে পাওয়া আবাসস্থল। অথচ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে কোটি কোটি টাকা। স্থানীয়দের দাবি, এই প্রকল্পে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা ছিল তা দেওয়া হয়নি, তেমনি নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ কারণে স্বস্তির আশ্রয়ণে চরম অস্বস্তিতে আছেন বাসিন্দারা। ভূমিহীনদের আশ্রয়ণের উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্পটি ডুবেছে দুর্নীতিতে।
পানিতে ডুবে থাকে সাজিয়ারার ৫৬ ঘর : খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সাজিয়ারা গফফার সড়কের কাছে মাধবকাঠী খাল ঘেঁষে গড়ে তোলা হয় আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ প্রকল্পে ৫৬টি ঘর নির্মাণ করে ৫৬ জন ভূমিহীন পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে চলতি বর্ষায় সবগুলো ঘরই পানিতে ডুবে আছে। বসবাসের অযোগ্য এই আশ্রয়ণ ছেড়ে প্রতিটি পরিবারই চলে গেছে অন্যত্র।
শুধু জলাবদ্ধতার সমস্যাই নয়, খুলনায় আশ্রয়ণে বসবাসকারী বাসিন্দা ও সুশীলসমাজের অভিযোগ, অপরিকল্পিত, দায়সারা ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নির্মিত হওয়ায় প্রতিটি আশ্রয়ণই ধুঁকছে নানা সংকটে। ঘরের প্লাস্টার ধসে পড়ছে। দেয়াল ও মেঝেতে ধরেছে ফাটল। ছাউনি দিয়ে পড়ে পানি। অনেক আশ্রয়ণে নেই সড়ক ও বিদ্যুৎ। আশপাশে নেই কর্মসংস্থানও। এরপরও অনেকেই পাচ্ছেন না জমির দলিল। এ ছাড়া কাদাপানি ও গরমে চর্মরোগে ভুগছেন তারা। মোটকথা, অস্বস্তির মধ্যে বসবাস করছেন আশ্রয়ণের বাসিন্দারা।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনার ৯ উপজেলায় ৫ হাজার ২৭২টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়। এর মধ্যে তেরখাদা উপজেলায় ৫১০টি ঘর, বটিয়াঘাটা উপজেলায় ৭৪৬টি, ডুমুরিয়া উপজেলায় ১ হাজার ১৫৫টি, পাইকগাছা উপজেলায় ৮৯০টি, দাকোপ উপজেলায় ৫৩৯টি, দিঘলিয়া উপজেলায় ৩৮১টি, ফুলতলা উপজেলায় ২৫২টি, রূপসা উপজেলায় ৫৬০টি ও কয়রা উপজেলায় ২৩৯টি ঘর দেওয়া হয়।
সূত্রটি জানায়, সরকারি খাসজমিতে তৈরি প্রতিটি ঘরে দুটি কামরা, রান্নাঘর, বারান্দা ও টয়লেট রয়েছে। সেমিপাকা ঘরগুলোর প্রতিটি তৈরি করতে প্রথম পর্যায়ে খরচ হয় ১ লাখ ৭১ হাজার, দ্বিতীয় পর্যায়ে খরচ হয় ১ লাখ ৯০ হাজার, তৃতীয় পর্যায়ে ২ লাখ এবং চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিটি পরিবারকে ২ শতাংশ জমিসহ এই ঘর দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।
বিভিন্ন উপজেলা আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম থেকেই ঘরের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ নিয়ম মেনে ঘর নির্মাণ হয়নি। নিম্নমানের ইট, রড, খোয়া ও বালু ব্যবহার করা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগে অনেক ঘর ভেঙে নতুন করে নির্মাণও করা হয়। কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে এসব অনিয়ম ধরাও পড়ে।
খুলনার ৯টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘর নির্মাণ হয়েছে ডুমুরিয়া উপজেলায়। তাই ঘর নির্মাণে অনিয়ম সম্পর্কে খোঁজ নিতে এ উপজেলার বাহাদুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে গেলে বসবাসকারী সাবিনা বেগম, জলি বেগম ও ফরিদা পারভিন জানান, ঘর নির্মাণে বালুর সঙ্গে সিমেন্টের পরিমাণ খুবই কম ব্যবহার হয়েছে। মেঝেতে ইটও বিছানো নেই। বালুর ওপর হালকা সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। ফলে মেঝেতে ফাটল ধরে উঠে গিয়ে বালু বের হচ্ছে। মেঝে ভেঙে নিজ খরচে তৈরি
করে বসবাস করতে হচ্ছে। ঘরের দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছে। অধিকাংশ ঘরের দরজা-জানালাও খুলে পড়ছে। যেনতেন ছাউনির কারণে বর্ষার পানি এসে ঘর ভিজে যায়। এ ছাড়া উঠান থেকে বারান্দা সামান্য উঁচু। এতে বর্ষা মৌসুমে পানি ও সাপ-পোকার ভয়ে থাকতে হয়। উঠান ও সড়কে হাঁটুসমান কাদা। পায়ে চামড়ায় ঘা হচ্ছে। কেউ অসুস্থ হলে কয়েকজন মিলে হাতে ধরে বা কাঁধে করে মূল সড়কে নেওয়া লাগে। আশ্রয়ণে যেন দুর্ভোগের শেষ নেই।
এ ব্যাপারে ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আল-আমিন বলেন, প্রকল্প অনেক আগেই সমাপ্ত হয়। তবে ডুমুরিয়ায় নানা কারণে অনেক কাজই বাকি ছিল। তিনি যোগ দেওয়ার পর থেকে পর্যায়ক্রমে সেগুলো করছেন। তবে জেলা প্রশাসক যাদের ঘর বরাদ্দ দিয়েছে, তাদের ঘরে উঠে যেতে বলা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দলিল দেওয়া হবে। এ ছাড়া যেহেতু প্রকল্পের বরাদ্দ আর নেই, সে কারণে স্থানীয়ভাবে ঘর মেরামত ও রাস্তা তৈরির চেষ্টা করা হবে। জনস্বাস্থ্যের মাধ্যমে গভীর নলকূপ ও পল্লীবিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান করা হবে।
এদিকে রূপসা উপজেলার সামন্তসেনা আশ্রয়ণে গিয়ে দেখা যায়, রূপসা-কাজদিয়া সড়কের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে ১৫টি ঘর। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এগুলো উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী। অথচ সেখানে একটি পরিবারও ওঠেনি। ঘরগুলো ঝোপঝাড়ে ঢেকে যাচ্ছে। দরজা-জানালায় মরিচা ধরেছে। এ গ্রামের বাসিন্দা সুমন জানান, নির্মাণের পর থেকে কোনো পরিবারকে সেখানে বসবাস করতে দেখা যায়নি।
তবে রূপসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনুর জাহান বলেন, রূপসায় অনেক আশ্রয়ণে ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন অথচ থাকেন না। এ বিষয়টি তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া অনেকে দলিল পাননি। সেগুলো দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে সামন্তসেনায় রেলের জমিতে সাবেক এমপি ঘরগুলো তার অর্থায়নে করেছিলেন। সেগুলো নিয়ে জটিলতা থাকায় কেউ ওঠেনি।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। ফলে ডিজাইন ও এস্টিমেট অনুযায়ী ঘর নির্মাণ হয়নি। আর প্রকল্পটি ছিল রাজনৈতিক প্রকল্প। ফলে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও আত্মীয়করণ হয়েছে। যাদের ঘর প্রয়োজন নেই, তারাও ঘর পেয়েছেন। পরে তারা ঘরে ওঠেনি।
অ্যাডভোকেট বাবুল আরো বলেন, উন্নয়ন দেখানো বা ভোটের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে তো আসলে হবে না। সম্ভাব্য যাচাইয়ের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন দরকার ছিল। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণে প্রকৌশল জ্ঞানের সঙ্গে স্থানীয় লোকায়েত জ্ঞান ব্যবহার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটি করা হয়নি।
খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব মুকুল কুমার মৈত্র বলেন, প্রকৃত ভূমিহীন যাচাই-বাছাই করে পর্যায়ক্রমে দলিল দেওয়া হচ্ছে। সে কারণে বিলম্ব হচ্ছে। তবে ঘর নির্মাণ অনেক দিন হয়ে গেছে। সে জন্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অনেক আশ্রয়ণে রাস্তা, গভীর নলকূপ নেই। এসব সংকট বা সমস্যা কাবিখাসহ নানা প্রকল্পের আওতায় করে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বর্ষার পানিতে শুধুই আশ্রয়ণের ঘর না, অনেক গ্রামও ডুবে গেছে। এজন্য খাল খননে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে বলেন, তিনি যোগ দেওয়ার পর কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে আগের খবর তার জানা নেই।

Share This Article