দেশের বৃহত্তম দ্বীপ জেলা ভোলার বিস্তৃর্ণ নিচু চরাঞ্চল কৃষকদের জন্য বড় ‘সংকট’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানকার অধিকাংশ জমি বছরে অর্ধেকের বেশি সময় জলাবদ্ধ থাকত, ফলে কৃষকরা তাদের জমিতে কিছুই চাষ করতে পারতেন না। ফলে সেগুলি পতিত হয়ে পড়ে থাকত এবং কৃষকরা নানা ধরনের আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতেন। কিন্ত বর্তমানে সর্জন পদ্ধতিতে সবজি চাষাবাদ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অল্প জমি ও পুঁজিতে বেশি লাভবান হওয়ায় নতুন এ পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে বেশ সাড়া ফেলেছে। বিশেষ করে নিচু জমিতে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকেরা।
পাশাপাশি ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে বিষমুক্ত সবজির ফলন ও দাম ভালো পাওয়ায় উৎসাহিত হচ্ছেন অন্যান্য কৃষকও। এ ছাড়া সর্জন পদ্ধতিতে ১২ মাস জমিতে সবজি আবাদ করা যায়।
এখন সেই সংকট কাটিয়ে সেখানে দ্রুত বদলে যাচ্ছে কৃষির চিত্র। এক সময় জলাবদ্ধতা ও যোগাযোগ সমস্যায় পতিত থাকা নিচু জমি এখন সর্জান পদ্ধতিতে বিভিন্ন ফসল ও মাছ চাষে ভরপুর হয়ে উঠছে।
‘কুইন আইল্যান্ড অব বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা করা জেলাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ১০-১৯ ফুট উঁচু। চারপাশে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর জলধারা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের প্রভাব এবং জোয়ার-ভাটায় বছরে দীর্ঘ সময় নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে থাকে। বর্ষাকালে জোয়ারের বেগে পানির উচ্চতা ১০-১৫ ফুট পর্যন্ত বাড়ে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নিম্নাঞ্চল প্রায় ডুবে থাকে, ফলে অধিকাংশ জমিতে ফসল ফলানো যায় না। এতে কৃষকরা বছরে মাত্র একটি ফসল ফলিয়ে বাকিটা সময় জমি পতিত রাখতে বাধ্য হতেন।
এ বিষয়ে ভোলার চর ফ্যাশন উপজেলার কৃষক আমিনুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, একসময় জমিতে ধান চাষ করতেন তিনি। নিচু জমি হওয়ায় প্রতিবছরই ঝড়, বন্যা এবং জলাবদ্ধতার কারণে জমিতে ধান চাষ করে আশানুরূপ ফল পাচ্ছিলেন না তিনি। এরপর স্থানীয় বেসরকারি এনজিও গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার কাছ থেকে পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে সর্জন পদ্ধতিতে সবজি আবাদ শুরু করেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ভোলা জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ড. শামীম আহমেদ বলেন, ‘সর্জান পদ্ধতি শুধু পতিত জমি ফিরিয়ে দিচ্ছে না, বরং কৃষিকে বাণিজ্যিক রূপ দেওয়ার বড় সম্ভাবনা তৈরি করছে।’
সর্জান পদ্ধতি কী:
সর্জান পদ্ধতি হলো একটি আধুনিক কৃষি কৌশল, যেখানে জমির কিছু অংশ উঁচু করে সেখানে সবজি এবং অন্যান্য ফসলের চাষ করা হয়, আর নিচু অংশে পানি ধরে রেখে মাছ চাষ করা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষকরা তাদের জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছেন। এর ফলে একই জমি থেকে দ্বিগুণ উৎপাদন পাওয়া যায়, যা কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
ড. শামীম আহমেদ জানান, ভোলায় ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ৩৫-৪০ শতাংশ পর্যন্ত। কারণ নদীনির্ভর যোগাযোগের কারণে উৎপাদিত পণ্য দ্রুত বাজারজাত করা যায় না। পরিবহনে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ফেরির ওপর নির্ভর করতে হয়, যা কৃষকের খরচ বাড়িয়ে দেয়। এ অবস্থায় জেলার কৃষকরা সর্জান পদ্ধতিকে বেছে নিচ্ছেন। এই পদ্ধতিতে জমির অংশ উঁচু করে বেড তৈরি করে সেখানে সবজি ও ফলের চাষ করা হয় এবং নিচু নালায় পানি ধরে রেখে মাছ চাষ করা হয়। একই জমি থেকে দ্বিগুণ উৎপাদনের সুযোগ থাকায় কৃষকরা দ্রুত লাভবান হচ্ছেন।
চরফ্যাসন উপজেলার আসলামপুরের কৃষক মো. হেলালের উদাহরণ ড. শামীম আহমেদ বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। গত বছর হেলাল ৩২ শতাংশ জমিতে সর্জান পদ্ধতিতে গাছ আলু, মরিচ, শিম, বেগুন ও পেঁপের চাষ করেন। নালায় তেলাপিয়া ও সরপুঁটি মাছ চাষও করেন। মাছ বিক্রি করে তিনি প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় করেছেন, পরিবারের চাহিদাও মিটিয়েছেন। গাছ আলু বিক্রি থেকে লাভ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। অন্যান্য ফসল মিলিয়ে তাঁর মোট লাভ দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা।
তিনি বলেন, গাছ আলু বা মেটে আলু একটি লতানো উদ্ভিদ, যা মাটির নিচে বড় আলু এবং কাণ্ডের গায়ে ছোট আলু উৎপন্ন করে। উভয় আলুই খাওয়ার উপযোগী এবং বাজারে এর ভালো চাহিদা রয়েছে। কৃষকরা সর্জানের আইলে গাছ আলু লাগাচ্ছেন, কারণ এটি বিশেষ যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠে এবং বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি করে।
ড. শামীম আহমেদ বলেন, ভোলা সম্ভবত দেশের একমাত্র জেলা যেখানে এত জমিতে সর্জান পদ্ধতিতে গাছ আলুর চাষ হচ্ছে। এতে জেলার শস্যবিন্যাস ২৫৮ শতাংশে পৌঁছেছে। তিন ফসলি জমি ৭০৪ হেক্টর থেকে বেড়ে এখন ১,০৫৪ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। চর এলাকায় শস্য নিবিড়তা বেড়ে ১৯৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই সাফল্যের পেছনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প যেমন কন্দাল উন্নয়ন প্রকল্প এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কার্যক্রম ভূমিকা রেখেছে। তবে উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে ভোলা খুব দ্রুত রপ্তানিমুখী কৃষি জেলায় পরিণত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোলার সর্জান পদ্ধতি বাংলাদেশের চরাঞ্চল কৃষিতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এই পদ্ধতির মাধ্যমে একই জমিতে মাছ ও ফসল চাষে কৃষকের আয় বাড়ছে বহুগুণ। উন্নত বাজার লিংকেজ ও দ্রুত পরিবহনের ব্যবস্থা হলে ভোলা হতে পারে দেশের প্রথম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও রপ্তানিমুখী জেলা।
সেখানকার কৃষি সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, একসময় যেখানে জলাবদ্ধ জমি ছিল এবং কৃষকদের ছিল হতাশা, আজ সেখানে সর্জান পদ্ধতির মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। কৃষকদের জীবনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে এবং তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটেছে। সর্জান পদ্ধতির প্রয়োগে ভোলার চরাঞ্চলে কৃষিতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আছে, যা অন্য অঞ্চলেও বিস্তার লাভ করার সম্ভাবনা আছে।