মায়ের রত্নগর্ভা সম্মাননা

রহিমা আক্তার মৌ

মাকে নিয়ে লেখার আগে একটু বাবার প্রসঙ্গে আসি। মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে অনেকদিনের। এরমধ্যে শুরু হয়েছে মহামারি করোনা। আতংক চারপাশে, কে কখন চলে যাই না ফেরার দেশে। বাবাকে নিয়ে কাজটা না করতে পারলে আফসোস থেকে যাবে। একজন লেখক হয়ে বাবাকে নিয়ে কাজটা করা আমার দায়িত্বে পড়ে। অবশেষে করোনাকালীন সময়েই শুরু। আমাদের তিন প্রজন্মের বই “মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান মতিন”। কেন্দ্রীয় চরিত্র আমার বাবা, লেখক আমি, আর প্রচ্ছদ শিল্পী আমার ছোট কন্যা ফারিহা আহসান অভ্র। বইয়ে আমার মায়ের একটা অংশ, যার শিরোনাম ” নাতিন নাতিন যাইবানি, শেখ সাব আইছে দেকপানি”। আমি যখন মায়ের গর্ভে সেই সময়ের ঘটনাই ছিলো সেটা, যা মায়ের মুখে শুনা। ২০২১ সালের শুরুতে বাবার হাতে তুলে দিই বইটি।

সবার মা পৃথিবীর সেরা মা। আমার কাছে শুধুই সেরা নয় মায়ের আদর্শেই আজ আমি এখানে। মা আমার প্রিয়ব্যক্তি। আর আমার মায়ের গুনাবলীর কথা লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না। বাবার বইটা করে ভাবলাম এবার মায়ের জন্য কিছু করা আমার দায়িত্ব। আমি আমার মাকে একজন রত্নগর্ভা বলি। আমরা চার ভাইবোন। বড়বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স প্রথম ক্লাস, বর্তমানে শিক্ষকতায় আছে। বড়ভাই (আমার ছোট) ডাক্তার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছে, ছোটভাই একজন ব্যাংকার, বর্তমানে একটি ব্যাংকের সিএফও এর দায়িত্বে আছে, আর আমি হলাম সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। আমাকে ছাড়াই আমার মা একজন রত্নগর্ভা।

সময় ২০২৪, নারী দিবস উপলক্ষে সাহিত্যে অবদানের জন্য ‘বীর ফাউন্ডেশন’ থেকে সম্মাননা দেয়া হয় আমাকে। এরকিছু দিন পর মা দিবস নিয়ে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। রত্নগর্ভা মায়েদের সম্মাননা দেয়া হবে, আবেদন করার জন্য। আমি আমার মায়ের জন্য আবেদন করি, আর আমার উত্তেজনা শুরু সেদিনই। আমাদের চারভাই বোনের অবস্থান ও বিস্তারিত জানাই। উনারা আমার মাকে রত্নগর্ভা সম্মাননা জানানোর জন্য যোগাযোগ করেন। আমি মাকে সব জানাই। মাকে জানানোর পর থেকে মায়ের ও ভাবনা। কি হবে, কিভাবে কি করবেন। ছুটে যাই মায়ের কাছে, মা বাবা সাভারে থাকেন। পরিবারের জন্য সারপ্রাইজ রাখতে বিষয়টা সবাইকে জানাইনি।

মা আমার কাছে সব জানতে চায়। আমি মাকে খুব সাধারণভাবেই বুঝিয়ে দিই। প্রায় ৭০ বছর বয়সে মা কোন মঞ্চে উঠবেন, ডায়াসের সামনে কথা বলবেন। বাবা একজন চাকরিজীবী, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। বাবা বহুবার মঞ্চে উঠেছেন। আমার সাথে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গিয়ে সাহিত্য প্রোগ্রামেও কবিতা বলেছেন, কিন্তু আমার মা এই প্রথম। মা শুধু মঞ্চেই উঠবেন না, একজন সেরা মা হিসাবে সম্মাননা গ্রহণ করবেন। মা নিজের কথা বলবেন। আমার ইচ্ছে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন বাবাও। তবে বাবাকে আগে থেকে কিছুই জানাইনি।

যথারীতি বাবা মা আসেন আমাদের বাসায়। বিকেলে আমি ওনাদের নিয়ে যাই অনুষ্ঠানে। মা বসে বসে দেখছেন অন্যদের, আর কি কি বলবেন তা মনে করে নিচ্ছেন। মাকে ডাক দেয়া হলো মঞ্চে যেতে, কথা বলতে। আমি মায়ের হাত ধরে মঞ্চে তুলে দিলাম। মা বলতে শুরু করলেন, আমি হা করে তাকিয়ে আছি মায়ের দিকে। কেউ বলবেনা উনি এই প্রথম বলছেন ডায়াসে কথা। সেই ১৯৭০ সালের আগে থেকেই বলছেন মা। ১৯৭০ সালের ৩ ডিসেম্বর বাবা মায়ের বিয়ে, বাবার যুদ্ধে যাওয়া। একে একে আমাদের জন্ম। গ্রাম থেকে শহর, সন্তানদের বড় হওয়া। খুব ঘুছিয়ে বলে যাচ্ছেন তিনি। আমি ছবি তুলি, মায়ের কথা ভিডিও করি।

একটুপর মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ান বাবা। বাবা শুধু বললেন, “আমার বলার কিছুই নেই, উনি খুব সুন্দরভাবেই সব বলেছেন”। আলোচনার পর সম্মাননা দেয়া শুরু। আরও আনন্দের বিষয় হলো প্রধান অতিথি ছিলেন আমার বাবারই একজন স্যার। বাবা সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় যিনি বাবার বস ছিলেন। মায়ের ছবি সহ একটা ক্রেস্ট, ছবি সহ সার্টিফিকেট দেয়া হলো। অনুষ্ঠান শেষে আমরা নেমে আসি, মায়ের হাতে সেই ক্রেস্ট। মা গাড়িতে বসে আছেন ক্রেস্ট হাতে। মায়ের চোখে মুখে আনন্দের ফুলঝুরি।

অফিসের ব্যস্ততার জন্য ছোটভাই অনুষ্ঠানে যেতে পারেনি। আমরা বাসায় আসি রাত নয়টায়, এদিকে মা দিবস উপলক্ষে একটা কেকের অর্ডার দেয়া ছিলো। অফিস থেকে ভাই আসে, এদিকে কেক আসে। বাবা মা ভাই সহ পরিবারের সবাই মিলে কেক কাটি। সবকিছুর মাঝে আমি আমার মায়ের মুখ দেখি। মায়েরা খুব অল্পতেই খুশি। আমি মায়ের আনন্দ দেখি। মায়ের ভেতরের অনেক কথা আজ তিনি বলতে পেরেছেন। অনেকের সামনে নিজের কথা সন্তানদের সফলতার কথা বলেছেন। একটুপর ছোটভাই বলে, “আমি আমার মাকে এর আগে কখনোই এতো উৎফুল্ল দেখিনি”।

ভাইয়ের কথায় আমার চোখ ভারি হয়ে আসে। হ্যাঁ আজ আমি মায়ের জন্য কিছু করতে পেরেছি। সম্মাননা ছোট বা বড় সেটা আসল নয় সম্মাননাই আসল। মা নিজের সম্মান পেয়েছেন। পরেরদিন বাবা মা কে নিয়ে বের হই, মেট্রোরেলে করে ওনাদের উত্তরা নিয়ে যাই। আবার মেট্টোরেলে করে ভাইয়ের অফিসে। এই প্রথম মা উনার সন্তানের অফিসে এসেছেন। ছোটভাই তার চেয়ারে মাকে বসালেন। মায়ের চোখেমুখে আনন্দের জোয়ার। অফিসের সবাই আসছে বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করছেন। বাবা আগেও এসেছেন ছেলের অফিসে, কিন্তু মা আজই প্রথম। খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়েছে। মা নিজেই দেখছেন ছেলের কর্মস্থল আর সহকর্মীদেরকে। বিদায়ের আগে অফিসের অনেকের সাথে ছবিতোলা হয়। সবাই মিলে বাসায় আসি।

সম্মাননার আয়োজন থেকে মাকে দুইটা সার্টিফিকেট দেয়। যেগুলোতে মায়ের ছবিও আছে। আমি সার্টিফিকেট গুলো লেমোনেটিং করে দিই যেনো নষ্ট না হয়ে যায়। বাবা মা চলে যান সাভারে। কয়েকদিন পর আমি গিয়ে দেখি মা যে ব্যাগ নিয়ে সব সময় বের হন সেই ব্যাগে মায়ের সার্টিফিকেট রাখা। নতুন জায়গায় গেলে মা অন্যদের তা দেখান।

মাত্র দুমাস আগের কথা। মা ছোটছেলের ব্যাংকের একটা শাখায় যান। শাখার ম্যানেজার যখন জানতে পারেন সিএফও স্যারের মা এসেছেন উনি নিজে মায়ের সাথে অনেক গল্প করেন। মায়ের সন্তানরা উপযুক্ত জায়গায় আছেন বলে দোয়া ও প্রসংশা করেন। বলেন, “খালাম্মা আপনি তো একজন রত্নগর্ভা”
সাথে সাথে মা নিজের ব্যাগ থেকে সেই সার্টিফিকেট বের করে দেখিয়ে বলেন,
“আমাকে তো রত্নগর্ভা সম্মাননা দিয়েছে, এই যে কাগজ”
মা নিজে আমাকে ঘটনাটা বলেন। আমি ভেতরে ভেতরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছি। সত্যিই আমি পেরেছি মায়ের জন্য কিছু করতে।

১৯৯১ সাল, আমি কলেজে পড়ি। মাকে একদিন কলেজ দেখতে নিয়ে যাই, মা প্রায় বলেন সে কথা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটা সাহিত্য প্রোগ্রামে মাকে নিয়ে যাই, মা আজও বলেন সে কথা। ২০১০ সালে গল্প লিখে প্রথম আলো থেকে সম্মাননা পায় আমার বড় কন্যা রৌদ্র মালিহা। আগারগাঁও চীনমৈত্রী সম্মেলনে দেয়া হয় সেই সম্মাননা। আমি আমার মাকে সাথে নিয়ে যাই। আজও মা বলেন সেকথা।
এই বিষয়গুলো খুব ছোট ছোট, কিন্তু মায়েদের কাছে এক আকাশ সমান। মায়েরা অনেককিছুতেই না বলেন, কিন্তু আপনি করে দেখান। দেখবেন মায়েরা কত খুশি হয়।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমাদের। ভিন্নতা রয়েছে মতামতে, ভিন্নতা রয়েছে সংস্কৃতি থেকে শুরু করে জীবন যাপনেও। একটা কথাই বলতে চাই আপনি যেমনিই হোন, আপনার অবস্থান বা কর্মক্ষেত্র যেমনি হোক, যত উচ্চপর্যায়ের হোক সম্ভব হলে আপনি আপনার বাবা মাকে সেখানে নিয়ে যান, ওনাদেরকে দেখান। হয়তো যেতে চাইবে না, কিন্তু যাওয়ার পর দেখবেন কত খুশি হন ওনারা।

আমার জন্ম কুমিল্লা সেনানিবাস হলেও বেড়ে উঠা নোয়াখালীতে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মা হাতের কাজ করেন, আমরা যাকে কুটিরশিল্প বলি। আমাদের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে মা এসব বিক্রি করতেন। আমার দেখা একসময় একজোড়া কাপড়ের হাতপাখা মা ২০/ টাকা বিক্রি করেছেন, আবার এক সময় ১২০/ টাকাও বিক্রি করেছেন। মায়ের হাতের শীতল পাটি আজও ব্যবহার হয় বাসায়। ১৯৯৪ সালে মা ঢাকায় আসেন। এখানে এসেও মা সংসারের পাশাপাশি হাতের কাজ করেন। একসময় মা কাগজের মুণ্ডু দিয়ে তৈজসপত্র বানান। কাগজের মুণ্ডু দিয়ে মায়ের হাতের বানানো তৈজসপত্র (চেয়ার, টেবিল, টুল, বাক্স) এখনও বাসায় ব্যবহৃত হয়। একটা সময় মায়ের এই কাজগুলো নিয়ে পত্রিকায় ফিচার লিখি। মা অনেক খুশি হোন।

মায়েরা আসলে এমনিই, মায়েদের সাথে কারও কোন তুলনা হয়না। আমি বলি, পৃথিবীতে এই একটি বর্ণের একটি অর্থবোধক শব্দ যার ব্যাখ্যা বা পরিধি কখনই মাপা যাবে না। মনে রাখবেন ‘মায়েরা হাসলেই হাসবে আপনার বিশ্ব’।পৃথিবীর সব মায়েরা ভালো থাকুন, সন্তানের আদর ভালোবাসায় থাকুন, নিরাপদে থাকুন। মায়েদের চোখের জল যেনো না হয় কষ্টের নোনাজল। মায়েদের চোখের জল হোক আনন্দের অশ্রু।

লেখক: সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

Share This Article