বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারত আপাতত কোনও ‘ফুল এনগেজমেন্টে’ যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা কোনও নতুন খবর নয়। বাংলাদেশে ভোটের পর একটি রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে তারপরই আবার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে, এটিই মোটামুটিভাবে দিল্লির ঘোষিত অবস্থান। ঠিক এই কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের কোনও মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বা সচিব সরকারি সফরে ভারতে আসেননি, ভারতও তাদের কাউকে আমন্ত্রণ জানায়নি।
এরকম একটা পটভূমিতে যখন জানা গেল, আগামী বুধবার (১৯ নভেম্বর) দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) খলিলুর রহমান তাতে যোগ দেবেন—সে খবর অনেককেই বিস্মিত করেছে। তাহলে এটা কি দুদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কোনও ইঙ্গিত, নাকি অন্য কোনও আলোচনার সুযোগ তৈরি করা—এই জল্পনাতেও যথারীতি সরগরম মূল ধারার ও সামাজিক গণমাধ্যম।
পাঁচ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা জোট ‘কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ’—এবারে যার সম্মেলন আয়োজিত হবে দিল্লিতে। গত বছরের জুলাই মাসে এই কনক্লেভের ডেপুটি এনএসএ পর্যায়ের সম্মেলন ভার্চুয়ালি আয়োজন করেছিল মরিশাস, সেখানেই বাংলাদেশ জোটের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। তার আগে জোটে বাংলাদেশের ভূমিকা ছিল অবজার্ভার বা পর্যবেক্ষকের।
এবারে স্বাগতিক দেশের এনএসএ হিসেবে অজিত ডোভালই সদস্য দেশগুলোতে তার কাউন্টারপার্টদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, ফলে খলিলুর রহমানও দিল্লিতে আসছেন অজিত ডোভালের আমন্ত্রণেই। কনক্লেভে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি বৈঠকের সাইডলাইনে তাদের দুজনের মধ্যে অবধারিতভাবেই আলাদা বৈঠক হবে, যদিও সেটার কথা বাইরে প্রকাশ করা হবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়।
খলিলুর রহমান অবশ্য শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মার বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। যে কারণে তার আসন্ন দিল্লি সফর নিয়ে জল্পনা আরও বেড়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে এনগেজমেন্টে আপত্তি থাকার পরও ভারত কেন বাংলাদেশের এনএসএ-কে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানালো? আর জানালোই যখন, দিল্লিতে তার সঙ্গে অজিত ডোভালের কী কী বিষয়ে আলোচনা হতে পারে?
‘নিরাপত্তার ইস্যু অপেক্ষা করতে পারে না’
ভারতের নীতিনির্ধারকরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলোর মীমাংসা কয়েক মাস পরে হলেও ক্ষতি নেই—কিন্তু নিরাপত্তার মতো সংবেদনশীল ক্ষেত্রে সেই অপেক্ষাটা করা সম্ভব নয়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তার কথায়, ‘আসলে ধরুন গঙ্গা চুক্তির নবায়ন নিয়ে আলোচনা নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরও শুরু হতে পারে, কিন্তু আমরা যখন দেখছি বাংলাদেশে এমন কিছু ডেভেলপমেন্ট ঘটছে যেগুলোর নিরাপত্তা প্রভাব (সিকিউরিটি ইমপ্লিফিকেশন) আমাদের ওপরেও পড়তে পারে তখন তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়।’
‘এমন কিছু ডেভেলপমেন্ট’ বলতে তিনি যে বাংলাদেশে সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ঘন ঘন সফর—চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক আলোচনা কিংবা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমউদ্দিন রেহমানি অথবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুতফুজ্জামান বাবরের মতো অনেকের জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়গুলোই বোঝাতে চাইছেন, সেটারও ইঙ্গিত দিচ্ছেন প্রায় খোলাখুলি।
এই ধরনের বিষয়গুলো ভারতকে উদ্বিগ্ন করেছে বলেই বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার সঙ্গে খোলাখুলি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে তারা।
লন্ডন-ভিত্তিক ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জিত দেবসরকারের কথায়, ‘বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় কনসার্নটা যে সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা, এটা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।’
‘এখন বাংলাদেশের মাটিকে যে ভারতবিরোধী কার্যকলাপে ব্যবহার করা হবে না কিংবা বাংলাদেশকে লঞ্চপ্যাড হিসেবে ব্যবহার করে কেউ ভারতের বিরুদ্ধে হামলা চালাবে না, এটা নিশ্চিত করাই দিল্লির প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশের এনএসএ-কে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানানোরও প্রধান কারণ এটাই’, বলছেন তিনি।
লুতফুজ্জামান বাবরের মতো বিএনপি নেতা—যার চট্টগ্রামে ট্রাকে করে অস্ত্র পাচার মামলাতেও সংশ্লিষ্টতা ছিল—তার মুক্তিকে ভারত যে সহজভাবে নিচ্ছে না সেই বার্তাও বাংলাদেশকে দেওয়া হতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন।
আর এই আলোচনার জন্য কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভ একটি আদর্শ প্ল্যাটফর্ম—কারণ এটি একটি ‘মাল্টিল্যাটারাল’ বা বহুপাক্ষিক ফোরাম এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাই যার প্রধান আলোচ্য। প্ল্যাটফর্মটি বহুপাক্ষিক হওয়ায় ভারত এটাও বলতে পারবে যে বাংলাদেশকে আলাদাভাবে দ্বিপাক্ষিক কোনও আলোচনার জন্য ডাকা হয়নি, বরং জোটের সদস্য হিসেবেই তারা আমন্ত্রণ পেয়েছে।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা
এই কনক্লেভের টাইমিং-টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সব ঠিকঠাক এগোলে আর মাত্র তিন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।
এই নির্বাচন নিয়েও ভারতের ঘোষিত অবস্থান সুষ্ঠু ও অবাধ—তার সঙ্গে নির্বাচন যেন পার্টিসিপেটরি (অংশগ্রহণমূলক) ও ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক) হয়। এই অবস্থানকে পর্যবেক্ষকরা ব্যাখ্যা করছেন এভাবে, যে ভারত চাইছে যে কোনোভাবেই হোক আওয়ামী লীগ যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম এখনও নিষিদ্ধ এবং আগামী নির্বাচনে তাদের যোগদানের কোনও সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও অতি সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসা এক ব্রিটিশ মন্ত্রীকে জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সে কারণে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লড়ার কোনও সুযোগ নেই।
স্পষ্টতই এখানে ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থানে বিরাট ফারাক রয়েছে এবং দিল্লিতে অজিত ডোভাল ও খলিলুর রহমানের মধ্যে আলোচনায় এই অস্বস্তিকর বিষয়টি আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারতে যারা এই ঘটনাপ্রবাহে সতর্ক নজর রাখছেন, সেই বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দুপক্ষ যাতে একটি ‘সমঝোতা’য় আসে, দুই এনএসএ-র আলোচনাতে তারও চেষ্টা হবে।
কিন্তু সমঝোতার ‘শর্ত’ হিসেবে ভারত যে কিছুতেই শেখ হাসিনাকে ‘হস্তান্তর’ বা বাংলাদেশর হাতে তুলে দেওয়ার দাবি মেনে নেবে না—সে ব্যাপারেও তারা পুরোপুরি নিশ্চিত। ফলে নির্বাচন নিয়ে দু’পক্ষ কোনও রফায় পৌঁছানোর চেষ্টা করলেও শেখ হাসিনা ইস্যুকে সেই দরকষাকষির বাইরে রাখারই চেষ্টা করবে ভারত।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সহজ করার উদ্যোগ?
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কে যে একটা অস্বাভাবিক শীতলতা গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিরাজ করছে, এটা সুবিদিত। বস্তুত গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফর এবং এই বছরের এপ্রিলে ব্যাংককে বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের মধ্যে বৈঠক বাদ দিলে এই সময়কালে দুদেশের মধ্যে তেমন কোনও ‘হাই প্রোফাইল এক্সেচেঞ্জ’ হয়নি বললেই চলে।
এর মাঝে অবশ্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের মধ্যে দুটি সংক্ষিপ্ত বৈঠক হয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে ও চলতি বছরের গোড়ায় ওমানের মাস্কাটে। ফলে দিল্লিতে খলিলুর রহমানের দিল্লি সফর হতে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনও হাই প্রোফাইল অতিথির প্রথম সফর।
খলিলুর রহমানকে ভারতে আমন্ত্রণ জানানোর এই পদক্ষেপকে দিল্লিতেও পর্যবেক্ষকরা অনেকে সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করার প্রয়াস হিসেবেই দেখছেন।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক সুকল্যাণ গোস্বামীর কথায়, ‘মাসতিনেক পরে ঢাকায় নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তাদের সঙ্গে দিল্লিকে তো ডিল করতেই হবে।’
‘এখন কথাবার্তা একদম বন্ধ—সেখান থেকে রাতারাতি আবার আগের মতো সম্পর্ক চালু করে দেওয়া, এভাবে তো আর হয় না। আমার ধারণা বাংলাদেশের এনএসএ-কে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে ধাপে ধাপে সেই স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরে যাওয়ারই বার্তা দিচ্ছে ভারত।’
প্রিয়জিত দেবসরকারও বলছিলেন, ‘দুটি সার্বভৌম দেশের দুজন শীর্ষ কর্মকর্তা (এখানে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা) যখন একই টেবিলে আলোচনায় বসেন, তখন অবশ্যই সেটা একটা ইতিবাচক বার্তা দেয়। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ব্রেকিং দ্য আইস’—আমি মনে করি, সম্পর্কের মধ্যে সেই বরফ গলার প্রক্রিয়াটাই এর মধ্যে দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে!’