
লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথ হচ্ছে বাংলাদেশের একটি মিটার-গেজ রেলপথ যা পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃক পরিচালিত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এ রেলপথ ১৯০৩ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের পরিচালনায় বেসরকারি লাকসাম-নোয়াখালী শাখা রেলপথ চালু হয়। ১৯০৫ সালে এই পথটি সরকার কিনে নেয় এবং ১৯০৬ সালের ১লা জানুয়ারি আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত করে দেয়। এই পথে লাকসাম থেকে নোয়াখালীর দূরত্ব প্রায় ৫২ কিলোমিটার। যাতে সংযুক্ত করা হয় ১২টি স্টেশন। বর্তমানে এই প্রাচীনতম রেলপথের অন্তত ৬টি স্টেশনের কার্যক্রম প্রায় দুই দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এসব স্টেশনে এখনো ট্রেন থামে, যাত্রীও ওঠে, টিকিটও বিক্রি হয় না।
পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, জনবলসংকটসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে এসব স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। তবে মানুষের কথা চিন্তা করে এখনো ট্রেনসেবা চালু রাখা হয়েছে। এসব স্টেশনে বিনা টিকিটে যাত্রী ওঠার পাশাপাশি বুকিং ছাড়াই মালামালও পারাপার হচ্ছে।
লাকসাম রেলওয়ে জংশন স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, লাকসাম থেকে নোয়াখালীর সোনাপুর পর্যন্ত দীর্ঘ রেলপথে মোট ১২টি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে লাকসামের দৌলতগঞ্জ, মনোহরগঞ্জের খিলা ও বিপুলাসার, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর বজরা, নোয়াখালী সদরের মাইজদী ও হরিনারায়ণপুর স্টেশনের কার্যক্রম ২০০৩ সালের পর থেকে পর্যায়ক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে লাকসাম পৌর শহরের দৌলতগঞ্জ স্টেশনটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আগে এই রেলপথে প্রতিদিন আন্তনগর, এক্সপ্রেস, লোকাল, ডেমুসহ অন্তত ১২টি ট্রেন চলাচল করত। বর্তমানে ঢাকা-নোয়াখালী রেলপথে আন্তনগর উপকূল এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেন চলাচল করে। আর তিনটি ভিন্ন নামে আরেকটি এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে। তবে ওই এক্সপ্রেস ট্রেনটি কখনো ঢাকা এক্সপ্রেস, কখনো নোয়াখালী এক্সপ্রেস আবার কখনো সমতট এক্সপ্রেস নামে চলাচল করছে। যদিও স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে এটি লোকাল ট্রেন নামে পরিচিত।রেল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লোকাল ট্রেনটি এক দিন নোয়াখালী-লাকসাম পথে চলাচল করে, আরেক দিন নোয়াখালী-ঢাকা পথে চলাচল করে।নোয়াখালী থেকে সকাল ৭টায় লাকসামের উদ্দেশে ছেড়ে আসে সমতট এক্সপ্রেস। লাকসামে এসে পৌঁছায় সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে। একই দিন সন্ধ্যা ৬টায় একই নামে নোয়াখালীর উদ্দেশে যায়। এরপর রাত ৮টা ৪০ মিনিটে নোয়াখালী এক্সপ্রেস হিসেবে ছেড়ে গিয়ে পরদিন ভোরে ঢাকা পৌঁছায়। সারা দিন অপেক্ষা করে ওই দিন সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে ঢাকা এক্সপ্রেস হিসেবে নোয়াখালীর উদ্দেশে ছেড়ে আসে ট্রেনটি।যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত তিনটি ভিন্ন নামে চলাচল করা ওই এক্সপ্রেস ট্রেনে টিকিট ছাড়াই লাকসাম-নোয়াখালী রেলপথের ছয়টি স্টেশন থেকে যাত্রী ওঠানামা করছেন। দৌলতগঞ্জ থেকে হরিনারায়ণপুর পর্যন্ত এসব স্টেশনে চলাচলের ক্ষেত্রে ট্রেনটিতে সর্বনিম্ন ২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা ভাড়া নেওয়ার কথা। কিন্তু স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধসহ টিকিট বিক্রেতা না থাকায় শতাধিক যাত্রী প্রতিনিয়ত বিনা টিকিটে যাতায়াত করছেন। বছরের পর বছর এভাবে বিনা টিকিটের স্টেশনগুলো চলতে থাকায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া ইউনিয়নের হাতিমারা গ্রামের জসিম উদ্দিন খান বলেন, নাথেরপেটুয়া স্টেশন আমাদের গ্রামের কাছাকাছি। একসময় এই স্টেশনগুলো জমজমাট ছিল। দিনরাত ট্রেনের হুইসেল ও ঝকঝকাঝক শব্দ আসতো। কিন্তু এখন সেই জৌলুশ নেই। স্টেশনগুলো বন্ধ থাকায় রাতে সেখানে মাদকসেবীদের আড্ডাসহ অসামাজিক কার্যক্রমও চলে। আমরা চাই, রেল সোনালি দিনে ফিরে আসুক। এসব স্টেশনের কার্যক্রম আবার চালু হোক।
লাকসাম রেলওয়ে কর্মরত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দৌলতগঞ্জ স্টেশনে একসময় তিনজন স্টেশন মাস্টার, তিনজন সহকারী স্টেশন মাস্টার, বুকিং ক্লার্ক, টালি ক্লার্ক, নিরাপত্তা বাহিনী, পোর্টারসহ বিভিন্ন পদে লোকবল নিয়োগ ছিল। বাকি স্টেশনগুলোতেও এভাবে কমবেশি লোকবল ছিল। কিন্তু সব পদই এখন শূন্য। লোকবলের সংকটে এসব স্টেশন বন্ধ হয়ে রয়েছে। দৌলতগঞ্জ স্টেশনটি দেড় দশক আগেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্টেশনটি ডাকাতিয়া নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় নদীপথে আসা মালামাল ট্রেনে আনা-নেওয়ার জন্য এটিকে ব্যবহার করা হতো।
সরেজমিনে দৌলতগঞ্জ স্টেশনে দেখা গেছে, টিকিট বেচা ও মালামাল পরিবহনে বুকিং কার্যক্রম বন্ধ। স্টেশন মাস্টারের কক্ষে ঝুলছে তালা। আশপাশে কোনো কর্মচারীও নেই।চারদিকে নোংরা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। স্টেশনের উত্তর-পশ্চিম দিকে মূল লাইন ও লুপ লাইনের জায়গাটি বেশ কয়েক বছর আগেই দখল হয়ে গেছে। সেখানে নির্মিত হয়েছে কয়েক‘শ অস্থায়ী দোকান, যার মধ্যে গড়ে উঠেছে লাকসামের বৃহৎ কাঁচাবাজার। স্টেশনটিতে বিভিন্ন বয়সী মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছেন। প্লাটফর্মে ভ্রাম্যমাণ হকার দোকান বসিয়েছেন।
পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) এ.বি.এম কামরুজ্জামান বলেন, জনবলসংকটের কারণে স্টেশনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এ জন্য সেখানে টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। এরপরও মানুষের কথা মাথায় রেখে পরিবহনসেবা চালু রাখা হয়েছে। তবে অনেক সময় এসব স্টেশন থেকে যাত্রী উঠলে ট্রেনে থাকা টিটিই যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছেন। তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ওই স্টেশনগুলো কীভাবে চালু করা যায় এবং কীভাবে টিকিট বিক্রি শুরু করা যায়, বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।