সংকট সমাধানে সামাজিক ব্যবসা, তারুণ্য ও প্রযুক্তির সমন্বয়ের আহ্বান ড. ইউনূসের

বাংলাদেশ চিত্র ডেস্ক

বিশ্বজুড়ে চলমান সংকট মোকাবিলায় সামাজিক ব্যবসা, তারুণ্য এবং প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন একটি বিশ্ব গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 

গতকাল সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ‘সামাজিক ব্যবসা, তারুণ্য ও প্রযুক্তি’ বিষয়ক উচ্চ-পর্যায়ের এক পার্শ্ব অনুষ্ঠানে মূল বক্তৃতায় তিনি এ আহ্বান জানান।

ড. ইউনূস বলেন, পদে পরিবর্তন এলেও তার উদ্দেশ্য একই—এমন একটি বিশ্ব তৈরি করা, যেখানে সবার জন্য সুযোগ, মর্যাদা এবং টেকসই জীবন নিশ্চিত হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব এক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের আগুন পৃথিবী পুড়িয়ে দিচ্ছে, বৈষম্য আরও গভীর হচ্ছে এবং সংঘাত মানবতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।’

তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই সংকটগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। এই সংকটময় সময়ে পুরোনো সমাধানগুলো যথেষ্ট নয়। 

তিনি একটি নতুন সভ্যতার আহ্বান জানান, যা কেবল লোভ দ্বারা পরিচালিত হবে না, বরং মানব ও বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে।

ড. ইউনূস তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ অনেক দেশই স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে ১.৩ মিলিয়ন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া, বারবার জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা মোকাবিলা করা এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা অন্যতম।

তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বাজেট বা সরকারি উন্নয়ন সহায়তা কমানো কোনোভাবেই ফলপ্রসূ হবে না। বরং আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং কারিগরি সহায়তা আরও বাড়ানো উচিত, যাতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো ন্যায্য পরিবর্তন নিশ্চিত করতে পারে।

ড. ইউনূস প্রচলিত ব্যবসার সংজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, ব্যবসা কেবল মুনাফা অর্জনের মাধ্যম হতে পারে না, বরং এটি মানবকল্যাণ এবং পরিবেশের সেবায় নিবেদিত হতে পারে।

তিনি তার প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্রঋণ উদ্যোগের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এক ডলারের ছোট ঋণ আজ একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শিক্ষা এবং খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসাগুলো প্রমাণ করছে, অর্থনৈতিকভাবে টেকসই থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের সবচেয়ে জরুরি সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নতুন সভ্যতা পুরোনো মানসিকতা দিয়ে তৈরি হবে না। এটি তৈরি হবে তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে। তিনি বলেন, পুরোনো ব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে আজকের তরুণরা ‘যা আছে’ তার পরিবর্তে ‘কী হতে পারে’ তা দেখতে পায়। তিনি বিশ্বাস করেন, যেখানে কল্পনা থাকে, সেখানে উদ্ভাবনও আসে।

তিনি তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন তাদের সৃজনশীলতা সামাজিক ব্যবসার দিকে প্রবাহিত করে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন, বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের টেকসই সমাধান সেখানেই জন্ম নেবে।

ড. ইউনূস বলেন, আমরা এখন প্রযুক্তির নতুন যুগে দাঁড়িয়ে আছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা, নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ অন্যান্য উদ্ভাবন সমাজের কাঠামোকে নতুন করে সাজানোর ক্ষমতা রাখে। তবে এর সঙ্গে গভীর দায়িত্ববোধও জড়িত। এই প্রযুক্তিগুলো মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ হবে নাকি ক্ষতির কারণ হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের আজকের সিদ্ধান্তের ওপর।

তিনি বলেন, প্রযুক্তিকে সামাজিক ব্যবসার নীতির সঙ্গে যুক্ত করে তা সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। যেমন এআই-চালিত স্বাস্থ্য পরিষেবা দূরবর্তী গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনা, এবং আইওটি (Internet of Things) ব্যবহার করে অনুন্নত অঞ্চলে ক্লিন এনার্জি ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব।

বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, এই সংকটময় সময়ে সত্যিকারের রূপান্তর আমাদের ঐক্যের ওপর নির্ভর করে। সামাজিক ব্যবসা, তারুণ্যের শক্তি এবং প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা সবচেয়ে জটিল বৈশ্বিক সংকটগুলো সমাধান করতে পারি। তিনি সবাইকে ন্যায়বিচার, স্থায়িত্ব এবং আশার ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন বিশ্ব গড়ার স্থপতি হওয়ার আহ্বান জানান।

Share This Article