সংগ্রামের প্রেরণার নাম বেগম খালেদা জিয়া

ডাঃ এ, কে, এম আহসান হাবীব

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যেগুলো কেবল একজন ব্যক্তিকে নয় এক যুগ, এক সংগ্রাম ও এক বিশ্বাসকে প্রতিনিধিত্ব করে। বেগম খালেদা জিয়া সেই বিরল নামগুলোর একটি। তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, বরং এক অদম্য প্রতিরোধের প্রতীক, এক আপোষহীন গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়। সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি ভবনজুড়ে নেমে আসে শোক ও আতঙ্কের ছায়া, আর গোটা জাতি ডুবে যায় অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। তখন বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন এক তরুণী বিধবা, রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সীমিত। কিন্তু সেই মুহূর্তে রাষ্ট্র ও জাতির ভবিষ্যতের ভার যেন তাঁর কাঁধেই এসে পড়ে। সদ্য বিধবা খালেদা জিয়া তখন সামরিক শাসন, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, বিদেশি প্রভাব, দলীয় অন্তঃকোন্দল সবকিছুর মাঝেও স্থিরচিত্তে বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অনেকেই ভেবেছিল, তিনি কেবল প্রতীকী নেত্রী হয়ে থাকবেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সফেদ শাড়ি পরিহিত খালেদা জিয়া প্রমাণ করেন নেতৃত্ব জন্মগত নয়, নেতৃত্ব আসে নীতিতে অবিচল থাকা ও সংগ্রামে দৃঢ় থাকার মাধ্যমে।
১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি সংগঠিত হয়, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্র, যুব, শ্রমিক সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তোলের এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে তিনি ছিলেন সেই অগ্রণী নেত্রীদের একজন, যার দৃঢ় অবস্থান ও আপোষহীনতা স্বৈরশাসকের পতন ত্বরান্বিত করে। যিনি এক মাত্র নেত্রী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যার নেতৃত্বে ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, জাসদ সহ এরশাদ বিরোধী সকল ছাত্র সংগঠন এক ব্যানারে মিছিল করে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল একটি ঘটনা। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তিনি গনতান্ত্রিক উপায়ে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং অর্থনীতি, অবকাঠামো, শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়নসহ বহু খাতে স্থায়ী উন্নয়ন ঘটান। সদ্য গনতন্ত্র ফিরে পাওয়া দেশে ফিরে আসে স্বস্তির নিশ্বাস।
তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবন সবসময়ই ছিল সংগ্রামে পরিপূর্ণ। বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকাকালে তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে অগণিত মিথ্যা মামলা, কারাবাস, শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন। ২০০৭ সালের ১/১১ সামরিক সমর্থিত সরকারের সময় তাঁকে স্পষ্টভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল রাজনীতি ছেড়ে দিলে মুক্তি মিলবে। কিন্তু তিনি বলেন, “রাজনীতি আমার কাছে ক্ষমতার খেলা নয়, রাজনীতি মানে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই।”
২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে ধ্বংস করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। ২০১৮ সালে কারাগারে পাঠানো হয় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায়, কিন্তু তবুও তাঁর ওপর চালানো হয় রাজনৈতিক শর্তে মুক্তির চাপ। চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে, তাঁকে নীরব আত্মসমর্পণের বিনিময়ে জীবন বাঁচানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি যে আমাদের আপোষহীনতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ইতিহাস সাক্ষী, সেই অদম্য দৃষ্টি তখনও তাঁর চোখে জ্বলজ্বল করছিল, যেভাবে শহীদ জিয়াউর রহমানের চোখে দেখা গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়।

আজ যখন বাংলাদেশে ভোটাধিকার ছিনতাই, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিরোধী মত দমন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত তখন বেগম খালেদা জিয়ার জীবন আমাদের শেখায়, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম মানে শুধু স্লোগান নয়, তা মানে অবিচল সাহস, ব্যক্তিগত ত্যাগ ও আপোষহীন নেতৃত্ব।
বয়সের ভারে তিনি হয়তো আজ শারীরিকভাবে দুর্বল, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ আগের মতোই শক্তিশালী। তাঁর কাছে ক্ষমতা কোনো লক্ষ্য নয় বরং জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাই চূড়ান্ত লক্ষ্য।
ফ্যাসিবাদবিহীন বাংলাদেশে তাঁর ৮০তম জন্মদিন কেবল আমাদের শুভেচ্ছা জানানোর দিন নয়, এটি আমাদের জন্য শপথ নেওয়ার দিন আমরা তাঁর মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষ করব না, স্বৈরাচারের সামনে মাথা নত করব না, এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকব
কারণ, ইতিহাসের রায়ে স্পষ্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে ঐক্য এবং আপোষহীনতার আরেক নাম বেগম খালেদা জিয়া।

ডাঃ এ, কে, এম আহসান হাবীব
চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈ্তিক বিশ্লেষক

Share This Article