
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ২০২৫ (আরপিও) জারি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে ইসিকে নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আদালত কর্তৃক ‘পলাতক’ ঘোষিত ব্যক্তি সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন বলেও উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও একক প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘না ভোট’, ইভিএম সংক্রান্ত সমস্ত ধারা বাতিল, মিথ্যা তথ্য বা ‘ফেক নিউজ’ দণ্ডনীয় অপরাধ; এসব বিধানও রয়েছে সংশোধিত আরপিওতে।
সোমবার (৪ নভেম্বর) আইন মন্ত্রণালয় এ অধ্যাদেশের গেজেট জারি হয়েছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একগুচ্ছ সংশোধন আনা হয়েছে আরপিও'তে।
অধ্যাদেশের মূল গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলো হচ্ছে-
একক প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘না ভোট’ (নো ভোট)
কোনও আসনে মাত্র একজন বৈধ প্রার্থী থাকলে, নির্বাচনটি সেই প্রার্থীর সঙ্গে ‘না ভোট’ অপশনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। যদি প্রার্থী ‘না ভোট’ অপশনের চেয়ে বেশি ভোট পান, তাহলে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। তবে, যদি ‘না ভোট’-এর সংখ্যা বেশি হয়, তাহলে রিটার্নিং কর্মকর্তা একটি নতুন তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে ওই আসনে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন। পরবর্তী নির্বাচনেও যদি আবারও একজন মাত্র প্রার্থী থাকেন এবং তিনি ‘না ভোট’-এর চেয়ে কম ভোট পান, তাহলেও তাকেই নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে (এই বিধান শুধুমাত্র দ্বিতীয়বারের জন্য কার্যকর হবে)।
ইভিএম সংক্রান্ত সমস্ত ধারা বাতিল
ভোটগ্রহণে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) বা উভয় পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ সংক্রান্ত আরপিও’র ২৬ অনুচ্ছেদের অংশবিশেষ বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া ইভিএম সংক্রান্ত আরপিও’র ২৬এ, ২৬বি, ২৬সি এবং ২৬ডি অনুচ্ছেদগুলো সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে।
প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ব্যালট এবং আধুনিকীকরণ
পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার সুযোগের পরিধি বাড়ানো হয়েছে, যার মধ্যে বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পোস্টাল ব্যালটের জন্য ভোটারদের কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তালিকাভুক্ত হতে হবে। প্রতিটি পোস্টাল ব্যালটে একটি অনন্য শনাক্তকারী নম্বর থাকবে, যা ব্যালটের ব্যক্তিগতকরণ ও তার গতিবিধি ট্র্যাক করতে ব্যবহৃত হবে। পোস্টাল ব্যালটের সুবিধা গ্রহণকারী অন্যান্যদের মধ্যে সরকারি সেবায় নিয়োজিত অন্য এলাকায় কর্মরত ব্যক্তি, কারাগারে বা বৈধ হেফাজতে থাকা ব্যক্তি এবং নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা অন্তর্ভুক্ত।
‘পলাতক’ ঘোষণা হলে প্রার্থিতা বাতিল
কোনও আদালত কর্তৃক ‘পলাতক’ ঘোষিত ব্যক্তি সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন। এই সংক্রান্ত একটি নতুন উপধারা (আর্টিকেল ১২(১)(এএ)) আরপিওতে সন্নিবেশ করা হয়েছে।
মিথ্যা তথ্য বা ‘ফেক নিউজ’ দণ্ডনীয় অপরাধ
আরপিওতে নতুন অনুচ্ছেদ ৭৩এ সংযোজন করা হয়েছে। ফলে নির্বাচন সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশের পর থেকে ফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত কোনও প্রার্থীর সুনাম ক্ষুণ্ণ করা বা নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করার উদ্দেশ্যে জেনেশুনে মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য, ছবি, ভিডিও, অডিও বা এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) দ্বারা তৈরি কনটেন্ট তৈরি, প্রকাশ, প্রচার বা শেয়ার করা দুর্নীতিমূলক কাজ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধে জড়িত ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, প্রচারণা সংস্থা বা গণমাধ্যম সংস্থা উভয়ই যৌথভাবে দায়ী হবেন এবং দণ্ডনীয় হবেন।
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে আয়কর রিটার্ন এবং সম্পদের পূর্ণ বিবরণ
মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীদেরকে সর্বশেষ করবর্ষের আয়কর রিটার্নের একটি কপি জমা দিতে হবে। মনোনয়নপত্রের হলফনামায় এখন থেকে দেশে ও বিদেশে থাকা আয় এবং নির্ভরশীলদের সম্পদের সম্পূর্ণ বিবরণী দিতে হবে। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।
প্রার্থীর জামানতের অর্থ বৃদ্ধি
মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় প্রার্থীর জামানতের অর্থ ‘২০ হাজার’ টাকার পরিবর্তে ‘৫০ হাজার’ টাকা করা হয়েছে।
সংসদ সদস্যের অযোগ্যতা সংক্রান্ত বিষয়ে ইসির ক্ষমতা
নির্বাচনের পরে কোনও সংসদ সদস্যের অযোগ্যতা সংক্রান্ত কোনও বিরোধ সৃষ্টি হলে নির্বাচন কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা অন্য কোনোভাবে অবহিত হয়ে বিষয়টি শুনানি ও নিষ্পত্তি করতে পারবে এবং কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে (আর্টিকেল ১২(৮)।
ভোটকেন্দ্রে অবাঞ্ছিত প্রবেশে কঠোরতা
প্রার্থী, প্রার্থীর এজেন্ট, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী বা অন্য কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি ভোটকেন্দ্র বা এর নির্ধারিত সীমানার মধ্যে অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি বা ভিড় করতে পারবেন না। কেউ এই নিয়ম ভঙ্গ করলে প্রিসাইডিং অফিসার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে সরিয়ে দিতে পারবেন এবং প্রয়োজনে গ্রেফতার করতে পারবেন, যা আরপিও’র ৭৯ অনুচ্ছেদের অধীনে শাস্তিযোগ্য।
ইসিকে নির্বাচন বন্ধ করার ক্ষমতা
জোর-জবরদস্তি, ভীতি প্রদর্শন বা অন্য কোনো দুর্নীতিমূলক কাজের কারণে অথবা ‘অ্যাক্ট অব গড’ জনিত কারণে কমিশন যদি নিশ্চিত হয় যে আইন অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব নয়, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে।
রাজনৈতিক দলের তহবিল স্বচ্ছতা
রাজনৈতিক দল কর্তৃক অনুদান হিসেবে প্রাপ্ত অর্থের বিস্তারিত বিবরণ এখন থেকে দলটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করতে হবে।
ভোট গণনায় ‘সমতা’ হলে
দুই বা ততোধিক প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট সমান হলে, শুধুমাত্র সমান ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্যে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।