বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমার একটি আগাম বার্তা দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ব্যাখ্যা করে তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্টত নির্বাচনি রোডম্যাপ দিয়েছেন। প্রত্যাশা করতে পারি যে, ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন কতটা প্রস্তুত? এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ, কে, এম নাসির উদ্দিন দাবি করেছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তারা পুরোপুরিই প্রস্তুত। এই লক্ষ্যে তারা প্রথম দিন থেকেই কাজ শুরু করেছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেল শান্তি বিজয়ী প্রফেসর মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বাংলাদেশের সংবিধান বা কোনও আইনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনও বিধান না থাকায় এই সরকার কতদিন দায়িত্ব পালন করবে, বা কত দিনের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে— তার কোনও দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়নি। সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে আসছে। অপরদিকে সরকার বারবারই বলে আসছে— ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে তারপর নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। দুই পক্ষের দুই ধরনের মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়নি। এছাড়া গত চার মাসে সরকারের উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য এসেছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে তার উল্টো ব্যাখ্যা দেওয়ার জের ধরে সংসদ নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। ফলে জাতীয় নির্বাচন বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কী হবে, সেটা নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়। যদিও সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেও্রয়া ভাষণে নির্বাচনের একটা টাইমফ্রেম জানান দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা ভোটের জন্য প্রস্তত বলে জানিয়েছেন। তবে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের মতো বিরাট কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে সদ্য দায়িত্ব নেওয়া নির্বাচন কমিশন কতটা প্রস্তুত— সেটা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ, কে, এম, নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশনার গত ২৪ নভেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। গত তিন সপ্তাহে তারা একটি কমিশন সভা করেছেন। ওই সভায় ৪টি কমিটি গঠন ও ভোটার তালিকা হালনাগাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, আইনের বিধান অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিকভাবে এবার ভোটার তালিকা হালনাগাদ হবে। মার্চের পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহসহ বড় পরিসরে কাজ করে তালিকা সংশোধনের মাধ্যমে একটি পরিপূর্ণ ভোটার তালিকা তৈরি করা হবে। ওই তালিকায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে এমন ইঙ্গিতও এরই মধ্যে কমিশন দিয়েছে।
ভোটার তালিকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত এলেও চেকলিস্ট অনুযায়ী নির্বাচনের বেশিরভাগ কাজই এখনও দৃশ্যমান নয়। অবশ্য কমিশন বলেছে, তাদের প্রস্তুতির বড় একটি অংশ নির্ভর করছে নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর। ওই কমিশন থেকে যেসব সুপারিশ আসে— সেটার ওপর ভিত্তি করে তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এছাড়া সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নির্বাচনের সংশ্লেষ রয়েছে বলে কমিশন জানিয়েছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভোটার তালিকা ছাড়াও সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের তথ্য যাচাই, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালা ও পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণসহ পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক বেশ কিছু কাজ রয়েছে ইসির। এর বাইরে এবার নতুন করে প্রবাসীদের ভোটদানের সুযোগের বিষয়টি জোরালো আলোচনা রয়েছে। বিগত তিনটি নির্বাচনের আগে যে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণেদিত আখ্যা দিয়ে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও সম্ভাব্য প্রার্থী ইসি বরাবর এরইমধ্যে অভিযোগ দিয়েছে। এই অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে সীমানা পুনর্নির্ধারণ ইসির জন্য সময় সাপেক্ষ্য ব্যাপার। এর বাইরে সময়মতো নির্বাচনি মালামাল সংগ্রহ এবং কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছানোর বিষয় রয়েছে। এছাড়া সংসদ নির্বাচন ব্যালেটে হবে না ইভিএমে হবে— সেটারও সুরাহার বিষয় রয়েছে। ইভিএমে ভোট করতে গেলে তা সংগ্রহের জন্য অর্থ সংস্থান ও সময়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অবশ্য আগামী সংসদ নির্বাচন ইভিএমে না করার বিষয়ে ইসির একটি ইঙ্গিত ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময় অনুযায়ী ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ভোট হলে গত ২৪ নভেম্বর দায়িত্ব নেওয়া নতুন কমিশন সময় পাবে এক বছরেরও কম। আর ২৬ এর জুনের মধ্যে ভোট হলে সেক্ষেত্রে দেড় বছরের মতো সময় পাবে। বিগত ৪টি কমিশনের দায়িত্বকাল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—তারা প্রায় সবাই সংসদ নির্বাচনের আগে হাতে দুই বছরের মতো সময় পেয়েছিল। সংসদ নির্বাচনের আগে চারটি কমিশনই ট্রায়াল রান হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কিছু নির্বাচন করে নিজেদের পোক্ত করার সুযোগও পেয়েছে। এদিকে বর্তমান কমিশন সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনও পরিকল্পনা করছে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা অনুযায়ী তারা সংসদ নির্বাচন করবে। এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনও চিন্তা তাদের নেই।
নির্বাচনের বিষয়ে মঙ্গলবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ, কে, এম, নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের জন্য আমরা প্রথম দিন থেকেই কাজ শুরু করেছি। জাতীয় নির্বাচনের জন্য যেসব প্রস্তুতির দরকার, তার সবই আমাদের রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের যে সময় ইঙ্গিত দিয়েছেন— সেই অনুযায়ী নির্বাচন করতে আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন সেটা জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে কোনও কিছু বলেননি। আমাদের যারা স্টেকহোল্ডার, রাজনৈতিক দল— তারাও সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছেন। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তাস্তরের কথা বলেছেন। কাজেই আমরা সংসদ নির্বাচনের কথা ভাবছি। এই মুহূর্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনও চিন্তা আমাদের নেই।’
সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে তারা প্রকাশ্যে কোনও রোডম্যাপ ঘোষণা দেবেন না বলে জানান সিইসি। তবে তাদের নিজস্ব একটি কর্মপরিকল্পনা থাকবে বলে জানান। অবশ্য তাদের নির্বাচনি কার্যক্রমের বেশ কিছু বিষয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর নির্ভর করছে বলে তিনি জানান।