![](https://bdchitro.com/wp-content/plugins/print-bangla-news/assest/img/print-news.png)
আমদানিকারকদের দাবি মেনে নিয়ে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। ধারণা করা হয়েছিল, এবার হয়তো বাজারে সয়াবিনের সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তা হয়নি। দাম বাড়ানোর ১০ দিন পরেও বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট রয়ে গেছে। মিল পর্যায় থেকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ডিলারের কাছে সরবরাহ কমিয়েছে। রমজান মাসকে সামনে রেখে দেশে সয়াবিন তেলের বাজারে অস্থিরতা রয়েছে এখনও। এ সংকট কবে কাটবে, কবে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক হবে- কারও কাছেই এ প্রশ্নের জবাব নেই। যদিও সরকার বলছে, সয়াবিন তেলের বাজারে অস্বস্তি কেটেছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাজারে যথেষ্ট পরিমাণে সয়াবিনের সরবরাহ রয়েছে। রাজধানীর একাধিক পাইকারি ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ডিলাররা চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিন তেলের সরবরাহ দিচ্ছেন না। সরকার আর মালিকরা যাই বলুক, বাস্তবে বাজারের চিত্র ভিন্ন। রাজধানীর একাধিক বাজার ও একাধিক মহল্লার খুচরা দোকানে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বাজারে ছোট-বড় ১০/১২টি কোম্পানি সয়াবিন তেল বাজারজাত করলেও সাতটির মতো কোম্পানি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ, টি কে গ্রুপের পুষ্টি, সিটি গ্রুপের তীর, স্কয়ার গ্রুপের রাঁধুনি, বসুন্ধরা গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের সয়াবিন তেল। বাকিরা এই বড় সাতটির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বড় কোম্পানির ডিলারের মাধ্যমে সয়াবিন তেল বাজারজাত করে।
এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, সরকার প্রায়শই বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে টিসিবির জন্য হাজার হাজার লিটার সয়াবিন তেল ক্রয় করে। সরকারকে দিতে গিয়ে বাজারে তাদের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এর একটা প্রভাব পড়ে বাজারে। পাশাপাশি এই সুযোগে বাকি ৬টি কোম্পানি বেশি মুনাফার আশায় কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ফলে সয়াবিনের বাজারের অস্থিরতা কাটে না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দুই দফা সয়াবিন তেলের ওপর শুল্ক কমিয়েছে। তারপরও পরিস্থিতি নাগালের আওতায় আসেনি। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, শুধু এই কয়েকটি কোম্পানির সিন্ডিকেটের কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সয়াবিন তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কাওরান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, দাম বাড়ানোর ঘোষণার পর ডিলাররা বাজারে আগের চেয়ে সরবরাহ কিছুটা বাড়িয়েছে। তবে নতুন দামের তেল এখনও অনেক বাজারে ছাড়া হয়নি। ফলে সেখানে আগের দামেই বিক্রি করছেন তারা।
এর আগে, গত ৯ ডিসেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ভোজ্যতেল পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। সেদিন তিনি জানিয়েছিলেন, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৫৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে, হঠাৎ খোলা বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি হয়। কোম্পানিগুলো কারসাজি করে এমনটি করেছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। ৬ ডিসেম্বর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাড়তি দামেও সয়াবিন তেল পাননি অনেক ক্রেতা- এমন অভিযোগও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সেই পুরনো চেনাজানা সিন্ডিকেট বাজার থেকে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতে কারসাজি শুরু করেছে। এবারের টার্গেট আসন্ন রমজান। এগুলো হচ্ছে আগাম প্রস্তুতি। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১ মার্চ থেকে শুরু হতে পারে রমজান। তাই এত আয়োজন। সরকারের কাছ থেকে দাম বাড়িয়ে নিয়েও বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক করছে না উৎপাদনকারীরা। মিল পর্যায় থেকে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ডিলারের কাছে সরবরাহ কমিয়েছে তারা। ডিলার থেকে খুচরা বাজারেও সয়াবিনের সরবরাহ কমেছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাড়তি দামেও চাহিদা মতো তেল পাচ্ছেন না খুচরা বিক্রেতারা। সয়াবিন তেল না পেয়ে বিপাকে পড়ছেন ভোক্তারা। রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে ক্রেতা ও ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে সয়াবিন তেলের সংকটের বিষয়টি জানা যায়। কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দেয়। প্রথম দিকে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কমে যাওয়ায় পরবর্তীতে বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় বোতলজাত সয়াবিন। এমন পরিস্থিতিতে চলতি ডিসেম্বরের ৯ তারিখ বাণিজ্য উপদেষ্টা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেন। দাম বাড়ানোর পর বদলে গেছে বাজারের চিত্র। এখন বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ বাড়লেও দাম নেওয়া হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি। উধাও হওয়া সয়াবিন তেল কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কীভাবে বাজারে এলো তা নিয়ে ক্রেতাদের প্রশ্নের শেষ নেই। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বৃদ্ধির ঘোষণার পর ডিলাররা বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়িয়েছে, যা আশানুরূপ নয়।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহে চার দিনের ব্যবধানে বন্দরে এসেছে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের চারটি জাহাজ। ৫২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আনা হয়েছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল থেকে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ১ হাজার ২৩৬ ডলারে বিক্রি হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে এই দাম ছিল ১ হাজার ৬৭৪ ডলার। সেই হিসাবে দাম কমেছে ২৬ শতাংশ। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় বাজারে একই সময়ে ভোজ্যতেলের দাম ছিল চড়া। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারপ্রতি ১৮৭ থেকে ১৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা ২০২২ সালের জানুয়ারিতে বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। বিশ্ববাজারে এ সময়ে সয়াবিন তেলের দাম কমতে থাকলেও বাংলাদেশের ভোক্তাদের কাছে তার সুফল পৌঁছায়নি।
এর কারণ জানতে চাইলে দেশীয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, উচ্চ আমদানি খরচ ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এর জন্য দায়ী। তিনি জানান, জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয় আগের তুলনায় বেশি। এ কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে সে অনুযায়ী কমছে না। অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন হয়েছে। বিদ্যমান বাজার পরিস্থিতির জন্য এটিও একটি কারণ।
সিটি গ্রুপের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, তারা সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি টন গড়ে ১ হাজার ৩০০ ডলার দরে সয়াবিন তেল কিনেছেন। যা মার্চ মাসে ঈদের পর বাংলাদেশে আসবে। ফলে রমজানে সয়াবিন তেলের বাজার শতভাগ স্বাচ্ছন্দ্যে আসবে না। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত স্থানীয় বাজার ভোজ্যতেলের কোনও সংকট নেই। তিনি আরও জানান, গত এক মাসে বৈশ্বিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ৮০ থেকে ৯০ ডলার বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাওরান বাজারের ভোজ্যতেলের পাইকারি ব্যবসায়ী একরাম উদ্দিন জানান, দেশের নামকরা ৬/৭টি কোম্পানি সিন্ডিকেট করে বাজারে সয়াবিনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। সরকারের সবাই তাদের চেনে। আগামী রমজানকে টার্গেট করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় তারা এটি করছেন। তারাই বর্তমানে সয়াবিন তেল মজুত করছেন, যা রমজানের সময় বেশি দামে বাজারে ছাড়বে।
বাণিজ্য সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন জানিয়েছেন, আসন্ন রমজানে শুধু সয়াবিন তেলই নয়, প্রয়োজনীয় কোনও পণ্যেরই সংকট হবে না। রমজানে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুত পর্যাপ্ত। সয়াবিন তেলের বাজার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আশা করছি আসন্ন রমজানে দেশের প্রতিটি মানুষ আনন্দময় রমজান ও ঈদ উদযাপন করতে পারবেন।
বাংলাদেশ ভোজ্যতেল পাইকারি বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বলেন, এক সপ্তাহ আগে প্রতি মণ (প্রায় ৩৭ কেজি) সয়াবিন তেলের দাম ছিল পাঁচ হাজার ৭০০ টাকা, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার টাকার কাছাকাছি দামে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২২ লাখ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ লাখ টন আমদানি করা হয়েছে।