এক ঘোরমেশানো ভালোলাগা নিয়ে সাবের চৌধুরীর 'জীবনে রোদ্দুরে' বইটি পড়ে শেষ করলাম। দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস, দর্শন, সমাজনীতি আর রাজনীতি বিষয়ক বই পড়তে পড়তে ক্লান্ত পথচারীর মতো কেমন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে 'জীবনে রোদ্দুরে' একটু জিরিয়ে নেয়ার অবকাশ এনে দিলো; কেমন যেন একটা শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো সারা দেহমনজুড়ে। অনেকেই ভাববেন আমি হয়ত প্রশংসার ডালি নিয়ে বসেছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বইটি নিয়ে যতই আলোচনা করি না কেন তা যথেষ্ট হবে না। হয়ত বহুদিন বাদে এরকম ঝরঝরে গদ্য পড়ছি বলেই ভালোলাগার পরিমাণ একটু বেশিই।
'জীবনে রোদ্দুরে' বইটিকে ঠিক কোন্ ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় তা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। তবে ভাবনারা ঠিকমতো তল খুঁজে পায়নি কিছুতেই। কখনও মনে হয়েছে- এটা তো সাবের চৌধুরীর আত্মজীবনী। কারণ, পুরো বইজুড়ে তাঁর নিজের গল্পগুলো মুক্তোর দানার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আবার মনে হয়েছে- এটা তো প্রবন্ধের বই। এমন অনেক বিষয় এই বইয়ে স্থান পেয়েছে, যা নিয়ে অনায়াসেই গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ রচনা করা সম্ভব। তবে এখানে কোনো কপট গাম্ভীর্য দেখতে পাইনি। বরং এক ধরনের সহজ-সরল সর্বজনবোধ্য ভাষায় অনেক জটিল বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে। মোটকথা, এই বইয়ের মূল আকর্ষণ হলো এর সাবলীল গদ্য। তা না হলে একজন পাঠক হিসেবে অতি অল্প সময়ে এতটা পথ পাড়ি দিতে পারতাম না।
সাবের চৌধুরীর উস্তাদ এবং আমার অন্যতম প্রিয় একজন লেখক মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীন বইটি নিয়ে ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'সাবের একই সঙ্গে চঞ্চল এবং খেয়ালি। ফলে তার সৃষ্টিশীলতায় জীবনের বাস্তবতা এবং কবির কল্পনা গলাগলি ধরে ঢেউ ভাঙ্গে।'
এই মূল্যায়ন আমাদের কাছে এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে- একজন পাঠক বইটি পড়তে গিয়ে পাতায় পাতায় এর বাস্তব নমুনা দেখতে পাবেন। এমন অনেক সিরিয়াস বিষয়ও তিনি কাব্যের ঢঙে উপস্থাপন করেছেন। ফলে পাঠ করতে গিয়ে পীড়াদায়ক কিছু মনে হয় না। মনে হয়- যেন নরম মখমলের ওপর দিয়ে পথ চলছি! বাক্যের গঠন ও চিন্তাশৈলী দেখেও মনে হয়েছে- যেন কবিতার বইই পড়ছি!
সাবের চৌধুরী প্রথম দিকে কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় আক্রান্ত ছিলেন কি? আমার কাছে শুরুর দিকের কিছু অংশ সামান্য এলোমেলো মনে হয়েছে; যেন গান শুরু করার আগে ঠিক তালটা খুঁজে পাচ্ছেন না। অথবা ফুটবল মাঠে বলের দখল নিয়ে একটা বিশৃঙ্খল ভাব বিরাজ করছে। তবে খুব দ্রুতই তিনি বলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন। প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে গেলেই পাঠক মূল ব্যাপারটি ধরে ফেলতে পারবেন। তখন আর কোনোকিছু এলোমেলো লাগবে না। সাবলীল গদ্য টানটান উত্তেজনায় ধরে রাখবে শেষ অবধি।
নির্ঝর, অববাহিকা, তরঙ্গ, কোলাহল- শিরোনামগুলো থেকে এক অসাধারণ দ্যুতিছড়ানো কাব্যময়তা প্রকাশ পেয়েছে। পাঠকের কাছে এই শব্দগুলো তারুণ্যের ঝংকারের মতো মনে হবে। আবার এই শিরোনামের অধীনে যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তাও সঠিকভাবে একে প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হয়েছে।
নির্ঝর অর্থ হলো ঝর্ণা; যা পাহাড় থেকে নেমে এসে বয়ে চলেছে জমিনের বুক চিরে। যার চলার পথের অববাহিকা পানিতে সিক্ত হয়ে সবুজে ভরে উঠেছে। 'নির্ঝর'-এ মূলত সাবের তার শৈশবের স্মৃতিময় দিনগুলোর গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। তার বৈচিত্র্যে ভরপুর শৈশবের গল্প শুনতে শুনতে আমিও যেন কল্পলোকে ভেসে হাজির হলাম আমার শৈশবে। আমিও প্রকৃতি খুব পছন্দ করি ছোটবেলা থেকেই। এখনও সুযোগ পেলে নেমে পড়ি সবুজ মাঠে, সময় পেলে বসে থাকি নদীর তীরে গিয়ে। সাবের তার শৈশবের পানসিতে চড়িয়ে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর মমতাময়ী মায়ের কাছে, তাঁর মক্তবের দিনগুলোতে। তিনি আমাদের হাজির করেছেন তাঁর বালকবেলার মাদ্রাসায়, তাঁর হাসিমুখো বন্ধুদের সামনে। তিনি যে বাড়িটিতে লজিং থাকতেন, সেটা কি আমাদের চোখের সামনে এখন ভাসছে না?
তরঙ্গ হলো ছন্দ, স্পন্দন, ঢেউ। এটা কিসের স্পন্দন- জীবনের? আমার তো সেটাই মনে হলো। একজন মানুুষ যখন শৈশবের দিনগুলো পেরিয়ে কিছুটা পরিণত হয়, তখন তার জীবনে সূচনা হয় এক অসাধারণ অধ্যায়ের। এ এমন এক সময়- যাকে শব্দের বৃত্তে বন্দী করে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। এখানে লেখকের সঙ্গে আমাদের কথা হয় শব্দ নিয়ে, আমাদের সাহিত্য নিয়ে। ইসলামি সাহিত্যের বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে এসেছে। লেখকের সঙ্গে আমি একটি বিষয়ে পুরোপুরি একমত হয়েছি এখানে এসে। তিনি মাদ্রাসাশিক্ষিতদের জন্য বাংলা সাহিত্যের মৌলিক বইগুলো পড়ার ওপর জোর দিয়েছেন। এতে ভাষাজ্ঞান পোক্ত হয়। একদম সঠিক কথা। মুসলিম পরিচয় নিয়ে সাহিত্যসাধনা করতে হলে এর তো কোনো বিকল্প দেখি না।
'অববাহিকা'য় এসে লেখকের চিন্তার জটিলতা উপলব্ধি করা যায়। একজন কবিও যেন তার স্বদেশ, সমাজ, ধর্ম নিয়ে চিন্তা করেন; তার সুসংহত প্রকাশ ঘটেছে এখানে। চিন্তা করার মতো কিছু টপিক আলোচিত হয়েছে এখানে।
'কোলাহল'- তা যদি হয় শিশুদের তাহলে এটা যেন জগতের সবচেয়ে মনোরম বিষয় হয়ে দেখা দেয়। যে সাবের চৌধুরীকে আমরা 'নির্ঝর'-এ শিশু হিসেবে পেয়েছিলাম, তিনিই 'কোলাহল'-এ এসে পিতা হয়েছেন; তাঁর ভেতরে জেগে উঠেছে এক অসাধারণ পিতৃস্নেহ। আমরা তাঁর ভেতরে থাকা একটি কোমল হৃদয়েরও সন্ধান পাই এখানে এসে।
পুরো ব্যাপারটিকে আমরা এভাবে ভাবতে পারি—একটা চারাগাছ জন্মের পর ধীরে ধীরে বড় হলো। তার জীবনে এসে জমা হলো বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। একদিন তার থেকে পাওয়া গেল নতুন, সজীব ফল। সে অনুভব করতে পারলো ফলের অস্তিত্ব।
চারটি অধ্যায়ের মূল বিষয় এটিই মনে হলো। এর মানে সাবের চৌধুরীর গল্প এখনও শেষ হয়নি। আমরা আরও নতুন গল্পের জন্য অপেক্ষায় থাকবো।
'আসলে অতি মুগ্ধতা মানুষকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলে।'
সাবের চৌধুরীর এই কথা হয়ত আমাকেও পেয়ে বসেছে। হতে পারে সেজন্যই আলাপ করতে করতে এতদূর চলে এসেছি। এই মুগ্ধতার কিছু কারণও অবশ্য আছে।
আমাদের সাহিত্য-সমাজে একটি কথা খুব জোর করে প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হয়েছে যে—মাদ্রাসার হুজুররা আবার সাহিত্যচর্চা করবে! এই নেতিবাচক ধারণার পেছনে হয়ত যৌক্তিক কিছু কারণও আছে। তবে অনেকদিন হলো এই অচলায়তন ভাঙতে আরম্ভ করেছে। মুহাম্মদ যাইনুল আবেদীনের লেখা পাঠ করে যে মুগ্ধতার সূচনা হয়েছিল, তাঁরই সাগরেদ সাবের চৌধুরী তাতে নতুন হাওয়া নিয়ে এসে হাজির হয়েছেন। আশা করি- তিনি এই মুগ্ধতার রেশ অনেকদিন ছড়িয়ে যাবেন।
আমার সাম্প্রতিককালে পড়া বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর প্রচ্ছদ হিসেবে কাজীদার এই কাজটিকে সেরা হিসেবে মেনে নেবো। হাতে নিয়েই মন ভরে যাওয়ার মতো একটি কাজ উপহার দিয়েছে পুনরায় প্রকাশন। তবে প্রতি পরিচ্ছদের শিরানামের ফন্টটি বড্ড চোখে লেগেছে। আরেকটু হ্যাংলাপাতলা হলে বোধহয় বেশি ভালো লাগতো। আর বইয়ের প্রকাশকাল লেখা হয়েছে ২০২১। হয়ত ভুলবশতই হয়ে থাকবে। বইটিকে বিশেষভাবে ভালোলাগার একটি কারণ হলো, অনেক সুন্দর ও দামী কিছু কথা রয়েছে। সেগুলো আমি ফাঁস করতে চাচ্ছি না। পাঠক নিজেই আবিষ্কার করতে পারবেন। তাছাড়া 'জীবনে রোদ্দুরে' আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে আমার শৈশবে। আমার মন বলছে, নামের মতোই সাবের চৌধুরীর বইটি পাঠকের হৃদয়ে রোদ্দুরের উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে।
বই : জীবনে রোদ্দুরে
লেখক : সাবের চৌধুরী
প্রকাশক : পুনরায় প্রকাশন
প্রচ্ছদ : কাজী যুবাইর মাহমুদ
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ২২৪
বাঁধাই : পেপারব্যাক
মুদ্রিত মূল্য : ৩৩৪/-