সাহিত্য, বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও পরাধীন মুক্তচিন্তার লেখক, কবি,ব্লগাররা। সমাজ, ধর্ম বা রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এখানে ঠিকে থাকতে পারেননি তাদের বেশিরভাগ। মুসলিম মৌলবাদীরা তাদের বহুজনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে আর কেউ-বা জীবন বাঁচাতে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কারও বই নিষিদ্ধ হয়েছে। আবার কারও কল্লার (মাথা) মূল্য নির্ধারিত হয়েছে। যারা টিকে আছেন, তারা স্র্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে টিকে আছেন। মনের কথাগুলো কখনও বলা বা লেখার সাহস করেননি পূর্ববর্তীতের সাথে ব্যবহার দেখে। আর ইহাও সত্য, কে স্বেচ্ছায় মৌলবাদীদের হাতে নির্মম খুন হতে চাইবে?
বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না- এ কথা যেমন অসত্য নয়, তেমনই বই লিখে অনেককে মরতে হয়েছে, দেশ ছাড়া হতে হয়েছে, সেটাও চরম সত্য৷ ধর্ম আর রাজনীতি এখানে এমনভাবে মিশে গেছে যে মুক্তচিন্তার লেখকরা বিলিন হলেই যেন সব পথের কাঁটা দূর হয় । স্বাধীন দেশে মুক্তচিন্তার উপর প্রথম আঘাত আসে কবি দাউদ হায়দারের উপর। তিনি অবশ্য বই লিখে নয়, কবিতা লিখে নির্বাসিত হন৷ ১৯৭৪ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এর সাহিত্য পাতায় তিনি ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখে এই পরিণতির শিকার হন৷ তার কবিতা ছাপা হওয়ার পর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে শুরু হয় প্রতিবাদ৷ এক শিক্ষক তার বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ এরপর তাকে নেওয়া হয় নিরাপত্তা হেফাজতে, পরবর্তীতে বিমানে করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ সেই থেকে নির্বাসিত আছেন তিনি৷ বাংলাদেশে সরকারের বহু পালা বদল হয়েছে; কিন্তু দাউদ হায়দারের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি৷ তিনি নির্বাসিতই থেকে গেছেন, একবারের জন্যও পা রাখতে পারেননি দেশের মাটিতে৷ বর্তমানে তিনি জার্মানিতে বসবাস করছেন৷
সময়টি ছিল ১৯৯২-এর অক্টোবর মাস। ২২ অক্টোবর ডানপন্থী পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবের শিরোনাম হয় ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘ’র এক সেমিনারে আহমদ শরীফ বলেন, “ইসলাম টিকে আছে ইতরদের মধ্যে।” এই কথাটাকে উদ্ধৃত করে জামাত উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। আহমদ শরীফের শাস্তির দাবীতে জামাতসহ প্রতিটি ইসলামিক দল রাস্তায় নেমে আসে। তাকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়। নিজামীর নেতৃত্বে জামাতে ইসলাম সংসদে ওয়াক আউট করে। সেসময় আহমদ শরীফের বাড়িতে ইসলামপন্থীরা বোমা নিক্ষেপ করে। সৌভাগ্যবশত কেউ আহত হয়নি।
মৌলবাদীরা ঘোষণা দিলেন আহমদ শরীফসহ কোনো নাস্তিকের জানাজা পড়াবেন না। আহমদ শরীফও ধর্মীয় নেতাদের জানাজা পড়ানোর অনুরোধ করেননি। ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯ আহমদ শরীফ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মারা যাওয়ার আগে তিনি লিখে যান- আমার মৃত দেহ বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের গবেষণার জন্য দান করবেন। মরণোত্তর দেহ দান করার দলিলে স্পষ্ট করে লিখে দেন- “আমার জানাজার প্রয়োজন নেই”।
ইতোপূর্বে বই বা লেখার অপরাধে মুক্তচিন্তার লেখকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, হামলা হলেও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপরাধে বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা প্রথম ঘটে ১৯৯৩ সালে৷ সেবার তসলিমা নাসরিনের বই ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধ হয়৷ ওই বইয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, মিছিল-মিটিং, নামে-বেনামে হত্যার হুমকি, এমনকি লেখিকার মাথার দাম পর্যন্ত ঘোষণা হয়৷ নারীবাদী এই লেখিকা মৌলবাদীদের আন্দোলনের পরিপেক্ষিতে দেশত্যাগে বাধ্য হন। এখনও তিনি নির্বাসিত।
পরবর্তীতে নারীবাদ নিয়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বই ‘নারী’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় ১৯৯৫ সালে, ২০০০ সাল পর্যন্ত ওই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল৷ মৌলবাদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে প্রকাশিত তার উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বাংলাদেশের একটি শ্রেণীকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছিল৷ একটি অপশক্তি তার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে, এমনকি ওই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তার উপর হামলা হয়৷ বইমেলা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজ বাসায় ফেরার সময় দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের কোপ তাঁকে মৃত্যুর মুখ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল৷ যদিও চিকিৎসকদের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত প্রাণে রক্ষা পান তিনি৷
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ প্রাণে বেঁচে গেলেও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায় অতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না৷ বইমেলায় যোগ দিতে স্ত্রীকে নিয়ে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসা অভিজৎকে টিএসসির কাছে রাস্তায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনিও বইমেলা থেকেই ফিরছিলেন৷ আরও কয়েকজন ব্লগার ও প্রকাশক একইভাবে খুন বা হামলার শিকার হয়েছেন৷
এই যে এক জনের মতের সঙ্গে নিজের মত না মিললেই অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ, শুধুমাত্র লেখার কারণে লেখকদের ‘মাথার’ দাবিতে রাজপথে মিছিল, নামে-বেনামে হত্যার হুমকি, আক্রমণ, হত্যা- এ যেন এক অস্থির সময়ে বাস করছি আমরা৷ সরকার থেকেও ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানো প্রতিরোধের নামে সেই লেখকদেরই হাত-পা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে৷ বই প্রকাশের ওপর নজরদারি বাড়াতে মাঠে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে ২০১৬ সালে বইমেলা চলার সময়ই ‘ব-দ্বীপ’ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ৷ গ্রেপ্তার করা হয় প্রকাশনীর মালিক শামসুজ্জোহা মানিককে৷ ‘ইসলাম বির্তক’সহ প্রকাশনীর আরও কয়েকটি বই জব্দ করা হয়৷
তাঁর প্রকাশনা সংস্থার অফিসেই জবাই করে খুন করে যায় ইসলামি জঙ্গিরা। একই দিন মুক্তচিন্তার লেখকদের বই প্রকাশক, লেখক ও কবি আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু এবং কবি তারেক রহিমের ওপরও ইসলামি জঙ্গিরা হত্যা করার উদ্দেশ্যে চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হামলা করে। এঁরা তিনজনকে দ্রুত হসপিটালে নিলে সৌভাগ্যক্রমে তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান। একই দিন এঁরা তিনজন প্রাণে বেঁচে গেলেও জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপন প্রাণে বাঁচতে পারেননি।
একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ধারাবাহিকভাবে লেখক, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের ওপর এই আক্রমণের সূচনা হয়েছে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। যিনি অনলাইন প্লাটফর্মে ‘থাবা বাবা’ নামে লেখালেখি করতেন।
জামায়াতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি সভাপতি খালেদা জিয়াও ব্লগারদের আন্দোলনকে ‘নাস্তিকদের আন্দোলন’ হিসাবে আখ্যায়িত করে তার বিরোধিতা করেন, জাতীয় সংসদে নাস্তিক ব্লগারদের কঠোর শাস্তি দাবি করেন। এভাবে ব্লগাররা রাজনৈতিকভাবে সমগ্র দেশের প্রশাসন ও জনগণের নিকট ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলেন। উল্লেখ্য, নেতিবাচক প্রচার-প্রপাগাণ্ডার কারণে ইসলামি দল ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ লোকদের নিকট ‘নাস্তিক’ শব্দটি খুবই ঘৃণিত ও অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়। তাছাড়াও ইসলামি গোষ্ঠী সবসময়ই নাস্তিকদের ব্লাসফেমি আইনে ফাঁসি দাবি করে আসছে। এমনকি তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলেছে, ‘সরকার যদি নাস্তিকদের ফাঁসি না দেয় তাহলে তারা এইসব নাস্তিক ব্লগারদের জবাই করে খুন করবে’।
এ লক্ষে ২০১৩ সালেই তারা ৮৪জন নাস্তিক ব্লগারের একটি তালিকা সারাদেশে প্রকাশ করে। এই তালিকা ধরে একে একে সবাইকে খুন করা হবে বলেও এইসব ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী বারবার প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। খুন হওয়া পাঁচজন ব্লগার-লেখকদের মধ্যে চারজনই ৮৪ তালিকাভুক্ত ব্লগার। গুরুতর আহতদের সংখ্যা বাদ দিলেও গত আড়াই বছরে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিদের হাতে খুন হওয়া মুক্তচিন্তার ব্লগার-লেখকদের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত সাতজন।
বাংলাদেশের মতো মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে যে দেশে শতকরা ৮৯% লোক মুসলিম, সে দেশে নিরীশ্বরবাদী এবং মুক্তচিন্তার মানুষরা নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি অংশ। যে অংশের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বা রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের কোনো ক্ষমতাই নেই। তারপরও এই ক্ষুদ্র অংশটি কেন জিহাদীদের প্রধান টার্গেট হলো সেটাই ভাবনার বিষয়। প্রকৃতপক্ষে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত, যুক্তিবাদী এবং মুক্তচিন্তার মানুষরা লোকবাদী বা প্রকৃত সেক্যুলার বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তি নির্মাণে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আর সে কারণেই আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলো মুক্তমনা ব্লগার, লেখকদের খুনের পিছনে ছায়া হিসেবে ভূমিকা রাখছে। সেই ছায়ার ভিতরে অনেক বড় বড় শক্তির অস্তিত্বও বিদ্যমান।
বস্তুত ইসলামি জঙ্গি বা জিহাদীদের পরিকল্পনায় ব্লগারদের ওপর সাম্প্রতিক হত্যা ও হামলা, একইসঙ্গে সরকার ও রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা এবং এমনকি এদের প্রতি প্রশ্রয়মূলক আচরণ, ব্লগার-লেখকদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার-নির্যাতনের হুমকি ও হয়রানিমূলক ভূমিকা সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের যে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও অনাস্থার জন্ম দিয়েছে তার কারণে ইতোমধ্যেই অনেক মুক্তচিন্তার ব্লগার-লেখক বাংলাদেশ ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে চলে গেছেন। কেউ কেউ পার্শ্ববর্তী দেশে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছেন; এবং এখনও অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যাবার চেষ্টা করছেন। এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এসকল ব্লগার-লেখকরা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চাকরি বা উন্নত জীবন কিংবা স্রেফ জীবিকার সন্ধানে পাশ্চাত্যে যাবার সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁরা মূলত নিজেদের নীতি-আদর্শকে রক্ষা করে জীবন বাঁচাবার জন্যই দেশত্যাগ করছেন। তাই তাঁদের দেশ ছেড়ে এভাবে চলে যাওয়াটা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
আর যারা দেশে আছেন, তাঁরা নিজেদের প্রাণ হাতে নিয়ে চলতেছেন। সঙ্গে সরকারি ও আইনী চাপ তো আছেই।
যার জ্বলন্ত উদাহারণ ঝুমন দাশ। যাহোক, সংক্ষেপে এই আলোচনায় এটুকু অন্তত বোঝা যায় যে, যারা ধর্ম এবং বিশেষত ইসলাম ধর্মের সমালোচক; তারা এই খুনীদের প্রধান টার্গেট হয়েছে। এবং এই ধরনের খুনের পিছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের রাজনীতির সংমিশ্রণও বিদ্যমান। আর এ কারণে মুক্তমনা লেখক-ব্লগারদের কাছে বাংলাদেশ এখন এক শ্বাপদের নাম।
লেখক : আজিমুল রাজা চৌধুরী
লেখক ও ব্লগার