সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বেশ কয়েকবছর ধরেই প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে। কারণ দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড পেয়ে খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন। দীর্ঘদিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বর্তমানে নিজ বাড়িতেই রয়েছেন তিনি। মুক্ত থাকলেও তাঁকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি বা বিশেষ জটিলতায় বিষয়টি ঘোলাটে করে রাখা আছে। তিনি যে মুক্ত সেটি নিয়েও সরকারের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের রয়েছে আলাদা আলাদা মত। কেউ বলেন তাকে জামিন দেওয়া হয়নি, বিশেষভাবে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আবার কেউ বলেন শর্তসাপেক্ষে তিনি তাঁর বাসভবনে রয়েছে। বিষয়টি অনেকাংশেই পরিষ্কার না। জামিন এবং মুক্ত দুটি শব্দ কাছাকাছি বা একইরকম অর্থের মনে হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুটি যেনো আলাদা দুই মেরু।
বিভিন্ন সময় সরকার দলীয় নেতাদের বক্তব্যে এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মহানুভবতায় ৪০১ ধারায় দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে দুই শর্তে তাকে মুক্তি দিয়েছেন। আইনমন্ত্রীও উপরোক্ত বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে বিনাশর্তে বা শর্তসাপেক্ষে কারও দণ্ড স্থগিত করতে পারে। পরবর্তী সময়ে সরকার স্থগিতাদেশের সময় বাড়াতেও পারে। আবার শর্ত ভাঙলে যে কোনো সময় স্থগিতাদেশ বাতিল করে দিতে পারে। একটি বিষয় স্পষ্ট জামিনে যে স্বাধীনতা রয়েছে, সে স্বাধীনতা ৪০১ধারা অনুযায়ী পাওয়া মুক্তিতে নাই।
পূর্বের একটি উদাহরণের কথা টানা যাক। সাবেক সেনা শাসক, জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ মাঝে মধ্যেই তাঁর দেওয়া বক্তব্য সংযোজন, বিয়োজন করতেন আবার অনেক সময় পুরো বক্তব্যই পাল্টে দিতেন। ৯০’এ ক্ষমতা হারানোর পর বিভিন্ন সময়ে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ’র নামে বেশ কিছু মামলা হয়। সেসবের বেশ কিছু মামলা স্থগিত হলেও কিছু মামলা তাঁর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত চালু ছিলো। মামলার কারণেই হয়তো তাঁকে ভোল পাল্টাতে হতো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রক্ষাপট বা ঘটনার প্রেক্ষিতে এরশাদ যখন শক্তভাবে কথা বলতেন, তখনই দেখা যেতো তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো গতিশীল হতো। আবার তিনি চুপ হলে, মামলাও নিশ্চুপ হয়ে যেতো। একটি বিষয় স্পষ্ট মামলার ফলেই তিনি তাঁর কথা ঠিক রাখতে পারতেন না।
সম্প্রতি সময়ে বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে ‘খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন, কি পারবেন না’ এ বিষয়টি নিয়ে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, রাজনীতি করতে পারবেন না, এ রকম কথা তো কোথাও নেই। তবে বাস্তব অবস্থা হলো অসুস্থতার কারণে তার দণ্ডাদেশ স্থগিত করা হয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে। তবে খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন না। কারণ তিনি দণ্ডিত। আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে খালেদা জিয়া’র রাজনৈতিক কার্যক্রমে আসতে বাঁধা নেই এমন বিষয়টি ধরেই নেওয়া যায়। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অপর আরেকটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া দণ্ডাদেশ থেকে মুক্তি পাননি, তার রাজনীতি করার সুযোগ নেই। একই বিষয় নিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, খালেদা জিয়ার বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে কারাগারের বাইরে ঘরে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেই শর্ত অনুযায়ী তিনি রাজনীতি করতে পারেন না। অপরদিকে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সাময়িক মুক্তির ক্ষেত্রে রাজনীতি করা নিয়ে কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি।
আইন মন্ত্রী ও কৃষি মন্ত্রীর বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্টভাবেই উঠে এসেছে খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন, কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। একই বিষয় নিয়ে মন্ত্রীদের পরস্পর বিরোধী দুই ধরনের বক্তব্য এসেছে।
একটি মহলে আলোচনা হচ্ছে বর্তমান সরকারকে দেওয়া বৈদেশিক চাপের কারণেই হয়ত খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাঁধা না থাকার কথা নিয়ে বলা হচ্ছে। এমন আলোচনা, গুঞ্জনেরও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা সচিবালয়ে জাপানি দূতের সাক্ষাতের পর আইনমন্ত্রী এবং অপর আরেকটি সাক্ষাতের পরে কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারলেও নির্বাচন করতে পারবেন না। তবে এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে অংশ নিতে দেওয়া নিয়ে বাইরের কোনো চাপ নেই।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুটি মামলায় হাইকোর্টে রায়ের পর লিভ টু আপিল করা হয়। লিভ টু আপিলের পরে জামিনের আবেদন করা হলেও তিনি জামিন বঞ্চিত হন। তবে জামিন বঞ্চিত হলেও ৪০১ ধারায় দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে দুই শর্তে তাকে মুক্তি দেওয়া। অপরদিকে সরকারদলীয় এক সংসদ সদস্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে ১০ বছরের সাজা হয়। পরবর্তীতে তিনি লিভ টু আপিল করেন। ১০বছরের সাজা বহাল রেখে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে তাঁকে জামিন দেন আপিল বিভাগ। খালেদা জিয়ার দুটি মামলায় লিভ টু আপিল দায়ের করলেও তিন বছর ধরে তা ঝুলে আছে।
বিএনপি প্রকৃত অর্থেই খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলন-কর্মূসচি দাবি তুলছেন। তাদের চাওয়া নির্বাহী আদেশের মুক্তি নয়, আইনী প্রক্রিয়ার মুক্তি। আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্তি পেলে তিনি স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন এবং বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিতে পারবেন। এক্ষেত্রে বলা যায়, আপোষহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিত খালেদা জিয়া জন্য মহানুভবতার মুক্তি বিএনপি চায়না, তারা চায় জামিনের মুক্তি। নির্বাহী আদেশে মুক্ত মানে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোনো সময় সাজা বহাল করে কারাগারে ফেরত নেয়া হতে পারে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন হুমকি-ধামকি দিয়ে বিএনপিকে অস্বস্তিতে ফেলার সুযোগ এখানে আছে।
খালেদা জিয়াকে নিয়ে বক্তব্যকে অনেকাংশেই রাজনৈতিক চাল ভাবছে বিএনপি। এ ইস্যুতে বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতাদের তেমন কোনো বক্তব্য দিচ্ছেনা, তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না। বিএনপি যেনো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন কর্মসূচিকেই প্রধান ভরসা হিসেবে মুল্যায়ন করছেন। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি আদায় করেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। এতো শত ঘটনার মধ্য দিয়েই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর জন্য আরো বিভিন্ন ঘটনা ঘটবে বলে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যায়।
বিএনপির চলমান আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নিয়ে সরকার শেষ পর্যন্ত কী করে দেটি দেখার অপেক্ষায় আমরা সাধারণ জনগণ। আসলেই কি ঘটছে সেটি দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
শেখ রিফাদ মাহমুদ (রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক)