অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আমাদের নন-ফিকশন বই আরও অনেক বেশি পড়া দরকার। ক্রমান্বয়ে আমরা ফেসবুকের তথ্যনির্ভর জাতিতে পরিণত হয়েছি। নন-ফিকশন বই না থাকলে আমাদের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে না। তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছরে আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে যে অনাচার চলেছে, সেটি নিয়ে আমরা বলতে পারি— জ্ঞানের রাজ্যে জেনোসাইড (গণহত্যা) হয়েছে।’
সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) বণিক বার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের যৌথ উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী অষ্টম নন-ফিকশন বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি কিছুদিন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে গ্রন্থকেন্দ্রে গত দুই বছরে কেনা বইয়ের তালিকা চাইলাম। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কী কী বই রাখে, ঘুরে দেখলাম। আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম, সেখানে কেনা বইগুলোর মধ্যে ৯৫ শতাংশই নন-ফিকশন। এবং এই ৯৫ শতাংশের মধ্যে ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা বা তাদের পরিবারকে নিয়ে। এমনকি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ওপরও প্রায় ২০-২৫টা বই আছে। এখানে একটা অনাচার চলেছে। জঘণ্য অকথ্যমানের বই কেনা হয়েছে, যেখানে কোনও ধরনের গবেষণা নেই।’
এ সময় ভালো গবেষণামূলক বইগুলোকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে মন্তব্য করে এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘অনেক লেখকের বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি উচ্চ আদালতের বিচারক উপন্যাসের ভাষা পরিবর্তন করে দিয়ে বলেছেন যে, এভাবে উপন্যাস লেখা যাবে না। উপন্যাস ছাপা হয়ে যাওয়ার পর ভাষা পরিবর্তন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় সর্বাধিনায়ক এ কে খন্দকারের একটা কথাকে কেন্দ্র করে একটি প্রকাশনা ওনার বই পুনঃমুদ্রণের সাহস করেনি ৫-৬ বছর। এই যে অনাচার চলেছে জ্ঞানের রাজ্যে, এটিকে মুক্ত করার এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থান, ছাত্রনেতা, যুবক, তাদের অভিভাবক ও সর্বস্তরের মানুষেরা। আমরা যেন এটিকে খুব ভালোমতো ব্যবহার করি। আমাদের এখানে যেন অনেক ভালো মানের গবেষণা ও এ ধরনের বইমেলা হয়, সে আশা রাখি।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বইয়ের এখন মর্যাদা ও আকর্ষণ কমেছে, সবই সত্য। কিন্তু এটাও সত্য যে, বই ছাড়া মানুষের চলবে না। বই মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশ, চর্চা ও অনুশীলনে সহযোগী। আমরা দেখছি, নন-ফিকশন বই ক্রমাগত মূল্যবান হয়ে উঠছে। এখন অনেক বাণিজ্য বেড়েছে। কিন্তু বাণিজ্যের মধ্যে যে মানবিকতার চর্চা দরকার, এই বইয়ের মেলা আমাদের সে কথাটাই মনে করিয়ে দেয়। আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা শুনছি। কিন্তু মানবিক বুদ্ধিবৃত্তির যে চর্চা, সেই চর্চা আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চা এক নয়। কাজেই মানুষ যতদিন কল্পনা করবে ও কল্পনা করার শক্তি লাগবে, চিন্তা করার শক্তি লাগবে, ততদিন সে মানুষ থাকবে এবং ততদিনই এ বইয়ের প্রয়োজন হবে।’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বণিক বার্তা নন-ফিকশন বইমেলা যেটি করে— সেটির গুরুত্ব আমরা দিনে দিনে, বছরের পর বছর আরও বুঝতে পারছি। বইয়ের ক্ষেত্রে লেখকদের প্রধান অনুপ্রেরণা হচ্ছে পাঠক। পাঠকরা যদি বই না পড়ে তাহলে লেখকদের কোনও উৎসাহ থাকে না। লিখতে গেলেও অনেক সমস্যা হয়। পাঠকদের কাছে পৌঁছানোটা অনেক কঠিন। বিশেষ করে নন-ফিকশন বই নিয়ে পত্রপত্রিকায় আলোচনা খুব কম হয়। রিভিউ তো হয়ই না। গ্রন্থ পর্যালোচনা বলে বাংলাদেশে এখন কিছুই হয় না। সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতি। এখানে মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যেটি পালন করা দরকার। সরকারেরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া দরকার। যেমন- জাতীয় গ্রন্থাগার, পাবলিক লাইব্রেরিগুলো যেন ঠিকঠাক বই কেনা বা বই প্রচারের যে দায়িত্ব, সেটি পালন করে। তাহলে ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার যে সংস্কৃতিটা তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে দেশ মুক্ত হবে।’
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন সাথী বলেন, ‘‘এখানে আসতে পেরে ব্যক্তিগতভাবে আনন্দিত। আমার ‘মওলানা ভাসানী ও বেহাত বিপ্লব’ বইটি বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, এটি আমার জন্য খুশির বিষয়। আমার এই বইটি লেখা বোধহয় স্বার্থক হলো। এই বই লেখার অনুপ্রেরণায় ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়া একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেই সময়টাকে যেভাবে দেখেছি এবং মওলানা ভাসানীর জীবন ইতিহাসকে আমি যেভাবে অধ্যায়ন করেছি— এই দেশে একটা বিপ্লব হতে পারতো। মোক্ষম সে সুযোগটি আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। সেজন্য ‘বেহাত বিপ্লব’ শব্দটা আমি ব্যবহার করেছি।’’
বণিক বার্তার প্রধান প্রতিবেদক মো. বদরুল আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের সুচনা বক্তব্য রাখেন— বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ এবং আয়োজনের প্রধান সহযোগী আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিওও কাজী মাহমুদ করিম।
এবারের মেলায় দেশের মোট ৩৯টি প্রকাশনা ও গবেষণা সংস্থা অংশ নিয়েছে।