১৯৭৮ সাল, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। সে বছরের ১ সেপ্টেম্বর বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ১৯ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়বিচার-ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার’ লক্ষে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নামে নতুন ধারা চালু করেন এবং সেটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন।
বিএনপির ১৯ দফা কর্মসূচির লক্ষ্য ছিলো; সর্বোতভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা, নিজেদেরকে একটি আত্বনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা, কোনো নাগরিক গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা, নিরক্ষরতার অভিশাপ হতে দেশকে মুক্ত করা, কৃষি উৎপাদন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, ব্যক্তি খাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিকাশ, সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।
দেশে কেউ যেন ভুখা না থাকে সেজন্য জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির কর্মসূচি ছিলো ব্যাপক। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদারের ক্ষেত্রেও বেশ অগ্রণী ভূমিকা ছিলো। সেসময় খাল খনন কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনে অভাবনীয় বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলো। আত্ম কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে স্বনির্ভর প্রকল্প এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বেশ প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিলো।
দেশ যখন এগিয়ে চলছে সমৃদ্ধির পথে; সেসময় ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামে বিপথগামী একদল সেনা অফিসার কর্তৃক নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয় তকজন খালেদা জিয়া সাধারণ একজন গৃহবধূ। সেসময় রাজনৈতিক কোনো কার্যক্রমেও তাঁকে দেখা যায়নি। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও তাঁকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। সেসময় বিএনপির কিছু নেতা জেনারেল এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগদান করে মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন।
দলীয় কোন্দলে বিএনপির যখন বিপর্যস্ত ও দিশেহারা সেসময় দলকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে বিএনপির’র রাজনীতিতে আগমন ঘটে খালেদা জিয়া’র। ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপি চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। সেই সময় থেকে খালেদা জিয়া্র দক্ষ নেতৃত্বে বিএনপি পরিচালিত এবং বিস্তৃত লাভ করেছে। বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে বিপর্যস্ত বিএনপিকে চাঙ্গা করে দলে রাজনৈতিক কার্যক্রম এগিয়ে নিতে থাকেন খালেদা জিয়া। তবে, এক্ষেত্রে সৎ শাসক হিসেবে সারাদেশে পরিচিত জিয়াউর রহমানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা খালেদা জিয়ার কার্যক্রমে দারুণভাবে কাজে দিয়েছিলো।
১৯৮৬ সালে যখন সবাই জেনারেল এরশাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ব্যস্ত; সে সময় নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে আপোষহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিত হন খালেদা জিয়া। জেনারেল এরশাদ ভেবেছিলেন, গৃহবধু থেকে সদ্য রাজনীতিতে উঠে আসা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিকে দিয়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা সম্ভব হবে না। তবে এরশাদের সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে বিএনপিকে নিয়ে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন খালেদা জিয়া। সেসময় আন্দোলনের কারণে তাঁকে বেশ কয়েকবার আটক করা হলেও, তিনি আন্দোলনের মাঠ ছেড়ে যাননি। মানসিকভাবে বেশ অটুট ছিলেন তিনি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে জনগণ সম্পৃক্ত হলে তা গণ আন্দোলন থেকে গণ অভ্যুত্থানে রুপ নেয় । সেই গণ অভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন । পরিসমাপ্তি ঘটে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে চলমান আন্দোলন সংগ্রামের।
১৯৯১সালের নির্বাচনে অনেকেই মনে করেছিলো বিএনপির পক্ষে হয়তো নির্বাচনে জয় লাভ করা সম্ভব হবে না। বিএনপির নেতাদের অনেকেই বেশ চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু সকলের সেই ভুল ভেঙ্গে দেন ক্ষমতা বাইরে থেকে রাজনৈতিক চর্চা ও ত্যাগ স্বীকার করা, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে সফল হওয়া দৃঢ় প্রত্যয়ী খালেদা জিয়া।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৯১সালের সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এ বিজয় খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ করে দেয়।
মাঝে পেরিয়ে গেছে বহুবছর। বারবার ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হতে হয়েছে বিএনপিকে। নানারকম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপিকে নিঃশেষ করার ছক কষলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে অত্যন্ত দৃঢ় ছিলো বিএনপি। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থেকে, লক্ষ লক্ষ মামলা মাথায় নিয়েও স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিলো, মনোবল থেকেছে অটুট। জেল, জুলুম, হুলিয়াকে পরোয়া না করে নিজ গর্জনে এগিয়েছে বিএনপি।
তারেক রহমানে যখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে বিএনপির হাল ধরেন তখন অনেকেই কটুক্তি করেছিলেন, বিভিন্নরকম বাজে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু সকলের ধারণা ভুল প্রমাণ করে তারেক রহমান দল পরিচালনায় নিজের পরিপক্কতার জানান দিয়েছেন। তিনি বিদেশের মাটিতে থেকেও যেভাবে স্মার্টলি বুদ্ধিমত্তা দিয়ে দল পরিচালনা করেছেন তাতে তিনি সর্বমহলের প্রশংসা ও সমর্থন পেয়েছেন। ছোট একটি তুলনা করতে ইচ্ছে করছে, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তান। সেখানেও তারেক রহমানের মতো দুইজন তরুণ নেতৃত্ব রয়েছে এবং তারা নিজেদের রাজনীতির হাল ধরেছেন। তারা হলেন রাহুল গান্ধী ও বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। তারা নিজ দেশে থেকেও সেভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জোর দিতে পারেননি। মোট কথা প্রতিপক্ষের বিপরীত সেভাবে শক্ত প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেননি। সে তুলনায় তারেক রহমান বহুগুণে এগিয়ে এবং তিনি সফল।
বিএনপির বিরুদ্ধে যতটা না ষড়যন্ত্র হয়েছে তারচেয়ে বেশি হয়েছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। শত শত মিথ্যা মামলা ও মিডিয়া সন্ত্রাসের মাধ্যমে তাঁকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যদিও সেসব সকল প্রচেষ্টাই একদম বৃথা। ফ্যাসিস্ট সরকার তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হওয়া কোনো দুর্নীতির মামলা প্রমাণ করতে পারেনি, সেসব মিথ্যা হিসেবে গণ্য হয়েছে। বরং চরিত্রহনন করতে গিয়ে উল্টো তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে শতগুণ। সাধারণ মানুষ ধিক্কার জানিয়েছে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারকে।
বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে সারাদেশে বিভিন্ন যৌক্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্দলীয় সরকারের অধিনে নির্বাচন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি সহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে বিএনপি। বিপুল পরিমাণ নেতাকর্মী ও জনসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সফল হয়েছে সেসব কর্মসূচি। দূরদেশ থেকেও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘন্টার পর ঘন্টা বিভিন্ন বিষয়ে বিশদ মতবিনিময়ের মাধ্যমে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে প্রাণসঞ্চার ঘটেছে। মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও।
বিগত ৪৬ বছরের হিসেব করতে গেলে বেশিরভাগ সময়ই ত্যাগ, তিতিক্ষা ও রাজপথে আন্দোলন-কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে বিএনপিকে। নেতাকর্মীদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও সব নির্যাতন, কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করার শক্তিই যেনো বিএনপির বড় অর্জন। অসুস্থ খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল চেকআপের জন্য মেডিকেলে যাবার সময় তাঁকে এক নজর দেখার জন্য লক্ষ জনতার ভীড় প্রমাণ করে বিএনপির জনপ্রিয়তা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে আগামীর সুন্দর, মানবিক, আধুনিক, তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে উঠুক এটাই সারা বাংলাদেশের প্রতিটি ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা।
শেখ রিফাদ মাহমুদ
উপদেষ্টা, গ্লোবাল স্টুডেন্ট ফোরাম
এডুকেশন রিলেশন অফিসার, কমনওয়েলথ স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন।