স্টাফ রিপোর্টার
একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠায় খুলনায় বাড়ছে না কর্মসংস্থান। সরকারি-বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এখানে ৫৮ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষই বেকার। এ বেকারত্ব কমিয়ে আনতে এখনই উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
খুলনা বিএল কলেজ থেকে ২০১৭ সালে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন খালিশপুরের বাসিন্দা মো. আলী আজগর।
দীর্ঘ ৭ বছরের চেষ্টায়ও মেলেনি চাকরি নামের সে সোনার হরিণ। পুঁজির অভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নও গেছে বিফলে। ৩২ বছর বয়সি এ যুবক এখনও পরিবারের অন্যদের ওপর বোঝা হয়ে আছেন। আজগর আলী বলেন, ‘মাস্টার্স শেষ করার পর গত সাত বছরে কত জায়গায় যে চাকরির চেষ্টা করেছি, তার ইয়ত্তা নেই। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দফতরে চাকরির জন্য আবেদন করেছি। যোগ্যতা থাকলেও নিজের পছন্দমতো কোনো চাকরি পাইনি। কোনো কোনো জায়গা থেকে গোপনে টাকা-পয়সা দেয়ার কথা বলে। আমার তো সে অবস্থাও নেই যে, আমি টাকা দিয়ে চাকরি করবো। মাঝে কিছু টাকা জমিয়ে একটা ব্যবসার চেষ্টা করেছিলাম। লোকসানে শেষ হয়েছি। ৩২ বছর বয়সে এখনও আমি পরিবারের অন্যদের ওপর ভর করে চলি।’ আজগরের মতো এমন হাজারও তরুণের গল্প আছে খুলনা নগরীর প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, জেলায় প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে মাত্র ৪২ শতাংশ কাজ করছেন। এর অর্থ ৫৮ শতাংশই দেশের অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। অথচ শিল্পনগরী হিসেবে খুলনার চিত্রটা বছর দশেক আগেও এমন ছিল না। সময়ের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে গেছে ১০টিরও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি পাটকল এবং ৫০-এর বেশি চিংড়ি রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে কাজ হারিয়ে কর্মহীন অনেকেই।
খুলনা ক্রিসেন্ট জুট মিলে চাকরি করতেন আসাদুল ইসলাম। চাকরির বয়স মাত্র তিন বছর হওয়ার পরপরই মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরিও হারান তিনি। সেই থেকে একপ্রকার বেকার তিনি। গত তিন বছরে আর কোনো চাকরি মেলাতে পারেননি।
২০২০ সালে খুলনা অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সরকার বন্ধ করে দেয়ায় চাকরি হারান পাটকলগুলোর স্থায়ী-অস্থায়ী প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক। এদের অনেকেই কাজের সন্ধানে ছেড়েছেন খুলনা শহর। কেউ দিনমজুরি করছেন, কেউ তরকারি বিক্রি করছেন। আবার অনেকে কোনো কাজই জোগাতে পারেননি।
আসাদুল বলেন, ‘আমাদের খুলনা নগরীতে একের পর এক কর্মসংস্থান বন্ধ হচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। আমরা কোথায় যাবো; কোথায় চাকরি খুঁজবো।’
শুধু খুলনা শহরের বাসিন্দা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকা থেকে কাজের খোঁজে প্রতিনিয়ত শহরমুখী হচ্ছেন অনেকে। তবে মিলছে না কাজ। পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলে নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা গেলেও জ্বালানি সংকটে তাও হয়নি। নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠায় নতুন কর্মসংস্থানও হয়নি এ অঞ্চলে।
চাকরিতে প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই চেষ্টা করেছেন উদ্যোক্তা হওয়ার। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, ব্যাংক ঋণ ও সরকারি সহায়তা না পাওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় তাতেও স্থায়ী হতে পারছেন না তারা। পড়াশুনা শেষ করে চাকরির পেছনে না দৌড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছেন এমন একজন নগরীর গল্লামারি এলাকার মাসুম বিল্লাহ। তিনি অনলাইনে ডিজাইনের কাজ করছেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। সেখানেও রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা।
মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা শুরুর ইনভেস্টমেন্ট। কেউ যদি আমার মতো অনলাইনে কাজ করতে চায়, প্রথমেই তাতে একটা ভালো মানের কম্পিউটার কিনতে হবে, সেটা অনেকেরই থাকে না। এ কাজের জন্য প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সরকারিভাবে সেই সহায়তাও খুব একটা পাওয়া যায় না। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ করানো হলেও তার খবরও অনেকে জানতে পারেন না। ফলে বেকারত্ব কমছে না।’
তবে যুব সমাজকে কর্মের যোগ্য করে তুলতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণসহ যুব উন্নয়ন অধিদফতর কাজ করলেও তা পুরোপুরি সফল হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থানের অভাবে।
যুব উন্নয়ন অধিদফতর খুলনার উপ-পরিচালক মো. মোস্তাকুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কাজই হচ্ছে যুবকদের কাজের জন্য তৈরি করা। এজন্য সরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। আমরা অনেককে চাকরি পেতে সহায়তাও করে থাকি। কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে ঋণের ব্যবস্থা করে থাকি। কেউ আমাদের থেকে ঋণ না পেলে কর্মসংস্থান ব্যাংকে ঋণ পেতে পারে সেজন্য সুপারিশ করে থাকি। তবুও আমি বলতে পারি, খুলনাতে কর্মসংস্থান কম থাকায় আমাদের এই প্রশিক্ষণ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না তারা। আরও কর্মসংস্থান তৈরি হওয়া প্রয়োজন খুলনায়।’ নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারি সহায়তা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান এ অর্থনীতিবিদের। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা কমাতে না পারলে সমাজে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম মুরাদ মামুন বলেন, ‘আমাদের এ অঞ্চলে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। পদ্মা সেতু চালুর পর এ অঞ্চলে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, জ্বালানিসংকটে তা হয়নি। এ অঞ্চলে গ্যাসের ব্যবস্থা করতে পারলে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। তাতে এ অঞ্চলের বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারকে ঋণ সহায়তা বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান তৈরি করা না গেলে কর্মহীন মানুষ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে।’ চার হাজার ৩৯৪ বর্গকিলোমিটারের এ জেলার মোট জনসংখ্যা ২৬ লাখের বেশি।
আপনার মতামত লিখুন :