মালয়েশিয়ায় কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষায় নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশ চিত্র ডেস্ক

আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া:১৮ জন সিনেটরের অংশগ্রহণে দীর্ঘ বিতর্ক শেষে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) মালয়েশিয়ার দেওয়ান নেগারা সংসদে, গিগ ওয়ার্কার্স বিল (প্ল্যাটফর্মভিত্তিক কাজ) ২০২৫ পাস করেছে। এই বিলটি মূলত ই-হেলিং ও পি-হেলিং সেক্টরের কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মানবসম্পদমন্ত্রী স্টিভেন সিম জানান, বিলটি বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা কাটিয়ে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে। বিশেষত স্বয়ংক্রিয় কর্তন ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মীদের আয়ের ১.২৫% সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থায় জমা হবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “প্রতিটি অর্জিত আরএম-১ এর জন্য মাত্র এক সেন কেটে নেওয়া হবে।”

বর্তমান প্রিপেইড মডেলের পরিবর্তে পোস্টপেইড মডেল চালু হওয়ায় কর্মীরা অগ্রিম অর্থ না দিয়েও কভারেজ পাবেন। এর ফলে গিগ কর্মীরা আরও সুবিধাজনক উপায়ে সুরক্ষা পাবেন, যেখানে পূর্বে বছরে আরএম ১৫৭.২০ থেকে আরএম ৫৯২.৮০ পর্যন্ত এককালীন অর্থ প্রদান করতে হতো।

বিলে মোট ১০টি অংশে ১১২টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে চারটি মূল দিক হলো, গিগ কর্মীদের সংজ্ঞা নির্ধারণ,  আয় ও কাজের পরিবেশ নিয়ে সিদ্ধান্তের জন্য ত্রিপক্ষীয় কাউন্সিল গঠন, বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ।

তবে বিল নিয়ে ভিন্নমতও দেখা গেছে। জাতীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন (NUJ) বিলটিকে স্বাগত জানালেও তারা একটি সংসদীয় নির্বাচন কমিটি গঠনের দাবি করেছে, যাতে আরও বিস্তারিত পর্যালোচনা করা যায়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তেহ আথিরা ইউসুফ বলেন, বৈষম্য ও অন্যায্য বরখাস্ত প্রতিরোধের মতো ধারা প্রশংসনীয় হলেও, বাস্তবায়নের আগে গভীরভাবে যাচাই জরুরি।

অন্যদিকে, মালয়েশিয়ান ট্রেডস ইউনিয়ন কংগ্রেস (MTUC)-এর সভাপতি হালিম মানসোর বিলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। যদিও পূর্বে সংস্থার মহাসচিব কামারুল বাহারিন মানসোর প্রস্তাবিত আইনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

এই বিল নিয়ে মালয়েশিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশি গিগ কর্মীদের মাঝেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কুয়ালালামপুরে ই-হেলিং সেবায় কর্মরত ফেনীর আবদুল করিম বলেন,
“আমাদের জন্য এটা স্বস্তির খবর। আগে দুর্ঘটনা হলে বা অসুস্থ হলে কোনো সুরক্ষা ছিল না। এখন অন্তত সরকারিভাবে কিছুটা নিশ্চয়তা থাকবে।”
অন্যদিকে সেলাঙ্গরে পি-হেলিং ডেলিভারিতে নিয়োজিত যশোরের রাশেদুল ইসলাম মনে করেন, আয়ের অল্প অংশ কর্তন হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল মিলবে। তার ভাষায়,
“আমাদের আয় খুব বেশি না, তবে ১.২৫% কেটে রাখলে ভবিষ্যতে বিপদে উপকার পাওয়া যাবে—এটাই আসল সুবিধা।” তবে সবাই সমানভাবে আশ্বস্ত নন। গোম্বাকে কর্মরত কুমিল্লার শহিদুল হক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন,
“অনেক সময় কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে আমাদের আয় থেকে বেশি কেটে নেয়। এই বিলের প্রয়োগ সঠিকভাবে হলে ভালো, কিন্তু যদি শুধু কর্মীদের ওপর চাপ বাড়ে, তাহলে আমরা সমস্যায় পড়ব।”
অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফাহিম হোসেন মনে করেন, এই বিল দীর্ঘমেয়াদে শ্রমবাজারকে আরও আনুষ্ঠানিক করবে। তিনি বলেন, “গিগ অর্থনীতি মালয়েশিয়ার কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখছে। বিলটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে প্রবাসীসহ সকল কর্মী নিরাপত্তা পাবেন এবং তা দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
শ্রমবাজার বিশ্লেষক ড. নূরাইজা ইউসুফ বলেন, “গিগ কর্মীরা এতদিন অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। তবে এখন তাদের আয়ের একটি অংশ কর্তন হলেও, তা মূলত একটি বিনিয়োগ—যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।”
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুনের মতে,“বাংলাদেশি ও অন্যান্য প্রবাসী শ্রমিকরা গিগ সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এই আইনের ফলে তাদের ন্যায্যতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত হলে তারা আরও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন, যা উভয় দেশকেই উপকৃত করবে।”
সর্বশেষে বলা যায়, সিনেটে পাস হওয়া এই বিল মালয়েশিয়ার লাখো স্থানীয় ও প্রবাসী গিগ কর্মীদের জন্য একটি নতুন সুরক্ষা বলয় তৈরি করেছে। তবে বাস্তবে এর সুফল কর্মীদের হাতে পৌঁছাতে হলে কার্যকর বাস্তবায়ন, স্বচ্ছতা এবং কোম্পানিগুলোর সহযোগিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।



ভালো সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ ফিডটি অনুসরণ করুন


Google News

Share This Article