প্রথমবারের মতো এশিয়ায় অনুষ্ঠিত গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স (জিআইজেসি) শুধু একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ নয়, এটি বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পরিবর্তিত বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি। ২০–২৪ নভেম্বর কুয়ালালামপুর কনভেনশন সেন্টারে এক ছাদের নিচে জড়ো হন বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশের ১,৫০০–রও বেশি অনুসন্ধানী সাংবাদিক, সম্পাদক, গবেষক ও মিডিয়া বিশেষজ্ঞ।
এই অংশগ্রহণের বিস্তারই ইঙ্গিত দেয়—যে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম রাজনৈতিক চাপ, নজরদারি ও আইনি ঝুঁকিতে ঘেরা, সেই পৃথিবীতেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এখনও হার মানেনি; বরং আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
কেন এই কনফারেন্স এশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অনুষ্ঠিত জিআইজেসি এর আগে কখনো এশিয়ায় আসেনি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে গত কয়েক বছরে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে, সাংবাদিকরা অনলাইন হয়রানি, রাষ্ট্রীয় নজরদারি এবং আইনি শাস্তির মুখে পড়েছেন। সে প্রেক্ষাপটে কুয়ালালামপুরে এই সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে একটি প্রতীকী বার্তা উঠে আসে। এই অঞ্চলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কাজ শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, সময়ের সবচেয়ে জরুরি কাজ।
মালয়েশিয়ার স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ‘মালয়কিনি’ সহ-আয়োজক হওয়াটাও গণমাধ্যম স্বাধীনতার লড়াইয়ে আরেকটি অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রযুক্তি—বন্ধু নাকি নতুন চ্যালেঞ্জ?
এবারের সেশনগুলোতে সবচেয়ে আলোচিত —কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা সাংবাদিকতা, ডিজিটাল ফরেনসিকস, নজরদারি প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা।
এআই এখন অনুসন্ধানকে দ্রুততর করছে, তবে একইসঙ্গে ভুয়া তথ্য তৈরি, নজরদারি বৃদ্ধি এবং সাংবাদিকদের ওপর নতুন ধরনের ডিজিটাল হামলার ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। একজন বক্তার ভাষায়,সত্য অনুসন্ধানের পথ এখন আগের চেয়ে দীর্ঘ, কিন্তু প্রযুক্তি তাকে আরও ধারালো অস্ত্র দিয়েছে।
গ্লোবাল সাউথের সাংবাদিকদের উপস্থিতি—একটি বড় পরিবর্তন:
জিআইজেসিতে এ বছর আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার সাংবাদিকদের উপস্থিতি ছিল নজরকাড়া। মালাউই, নেপাল, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, মায়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিকরা বলেছেন, তাদের দেশে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার জটিল রূপ নিয়েছে। তথ্য প্রাপ্তি কঠিন, ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি, তবুও অনুসন্ধান থেমে নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্লোবাল সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ এখন উত্তর-পশ্চিম নয়, বরং দক্ষিণ ও পূর্ব বিশ্বের হাতে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বর্তমান সংকট:
বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক জরিপ ও পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে—অধিক সংখ্যক দেশে সাংবাদিকদের ওপর মামলা বৃদ্ধি, অনলাইন ‘ট্রল আর্মি’ দিয়ে হয়রানি, মিডিয়ার আর্থিক সংকট, স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ঝুঁকি।
তবুও একটি তথ্য ইতিবাচক—মানুষের কাছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতা এখনো সর্বোচ্চ। দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং পরিবেশ–অপরাধ নিয়ে সাহসী রিপোর্ট বহু দেশে নীতি পরিবর্তন ও জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।
সেশনগুলোতে যে বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে আসে- ডেটা–নির্ভর অনুসন্ধান পদ্ধতি, সীমান্তপারের যৌথ তদন্ত (Cross-border collaboration), রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ এলাকায় নিরাপদে কাজ করার কৌশল, ফ্যাক্টচেকিং এবং ডিসইনফরমেশন মোকাবিলা, জলবায়ু অপরাধ ও কর্পোরেট দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান, লাভজনক নয় এমন স্বাধীন মিডিয়ার টিকে থাকার উপায়। বিশেষত স্বৈরাচারী শাসনের দেশে কার্যরত । সাংবাদিকরা বলেছেন, ভয় এখন প্রতিনিয়ত সঙ্গী, তবে নীরবতা আরও ভয়ংকর।
পুরস্কার বিতরণী—ঝুঁকির মধ্যেও সত্যের জয়:
২৪ নভেম্বর সমাপনী দিনে বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে কাজ করা সাংবাদিকদের সেরা অনুসন্ধানগুলো পুরস্কৃত হবে। গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত করতে এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যে সাহস প্রয়োজন, এই পুরস্কারপ্রাপকদের কাজ তা–ই প্রতিফলিত করে।
জিআইজেসি ২০২৫ দেখিয়ে দিল, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা মরে যায়নি, বরং আরও সংগঠিত হচ্ছে। প্রযুক্তি এর পরিসর বাড়াচ্ছে,সহযোগিতা নতুন শক্তি, গ্লোবাল সাউথ এখন নেতৃত্বে আসছে, তথ্যপ্রাপ্তির লড়াই আরও জটিল হবে। কিন্তু সত্য অনুসন্ধানের প্রয়োজন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স শুধু একটি আয়োজন নয়, এটি এক ধরনের ঘোষণা—বিশ্ব যতই সংকটে পড়ুক, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা থেমে থাকবে না।
ইউআরএল কপি করা হয়েছে