জুলাই বিপ্লবে আহত না হয়েও গেজেটভুক্ত হয়ে প্রতিমাসে তুলছেন আহত জুলাই যোদ্ধার ভাতা

বাংলাদেশ চিত্র ডেস্ক

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে জুলাই বিপ্লবের পর দোকান নিয়ে মারামারির ঘটনায় আহত হয়ে নিজেকে জুলাই আহত যোদ্ধা হিসেবে দেখিয়ে প্রতিমাসে সরকারি ভাতা তোলার অভিযোগ উঠেছে জুবায়ের ইসলাম নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে।

অভিযুক্ত জুবায়ের ইসলাম দেবীগঞ্জ পৌরসভার উত্তর পাড়া এলাকার রেজাউল করিমের ছেলে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৫ সালের ৫ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে রংপুর বিভাগের ‘গ শ্রেণির’ আহত জুলাই যোদ্ধার তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় গেজেট নাম্বার ১০২০ এ পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলা থেকে আহত জুলাই যোদ্ধা হিসেবে জুবায়েরর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর সরকারে পক্ষ থেকে এককালীন এক লক্ষ টাকা অনুদান এবং প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে দশ হাজার টাকা করে ভাতা তুলছেন অভিযুক্ত জুবায়ের।

এদিকে অভিযোগ উঠেছে গেজেটভুক্ত আহত জুলাই যোদ্ধা জুবায়ের দেবীগঞ্জে জুলাই বিপ্লবের সময় অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৪ ও ৫ আগস্ট আহত হন নি। তিনি ৬ আগস্ট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের সামনে একটি দোকানের মালিকানা নিয়ে দুই পক্ষের ধস্তাধস্তিতে সামান্য আহত হন। তবে এই ঘটনায় পরবর্তীতে তাকে জুলাই বিপ্লবে আহত হিসেবে দেখিয়ে গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জামাল হোসেন নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের বিপরীতে অবস্থিত একটি দোকান নিয়ে জুবায়েরের চাচা রফিকের সাথে আমাদের কয়েকজনের বাকবিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে জুবায়ের এসে আমাদের সাথে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে হাতাহাতির একপর্যায়ে তার মাথায় এবং হাতের আঙ্গুলে আঘাত লাগে। এরপর সে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং পরবর্তীতে থানায় অভিযোগ করলে পরে সেটির আপোষ হয়।

চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী একাধিক ছাত্র নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায় পুরো জুলাই বিপ্লবে দেবীগঞ্জ উপজেলায় শুধুমাত্র ৪ আগস্ট অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। সেদিন সকাল থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন বিজয় চত্বরে অবস্থান নেয়। কিন্তু সেদিন বিকেলে দেবীগঞ্জে প্রবেশের সময় করতোয়া সেতুর পশ্চিম পাড়ে এবং তিস্তারহাটে বিপ্লবী ছাত্র জনতার উপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সেদিন সেতুর পশ্চিম পাড়ে রবিউল ইসলাম রুবেল নামে একজন গুরুতর আহত হয়ে সেদিনই হাসপাতালে ভর্তি হন।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার নিয়ন্ত্রণে ছিল দেবীগঞ্জ। সেদিন হাসিনা পতনের পর বিজয় মিছিল করে যে যার মতো বাসায় চলে যায়। এই দুই দিনে জুবায়ের অংশ নিলেও তিনি আহত হন নি।

এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ আল কাফী শায়ের নামে এক ছাত্র নেতা বলেন, আমরা জানতে পারি জুলাইয়ের যে আহতদের গেজেট করা হয়েছে সেখানে জুবায়ের ভাইয়ের নাম দেয়া হয়েছে। জুবায়ের ভাই জুলাই আন্দোলনে ছিলেন কিন্তু ৪ ও ৫ তারিখ আহত হন নি। ৬ আগস্ট পারিবারিক দোকানের জমি ন য়ে বিরোধে তিনি আহত হন অথচ তাকে জুলাইয়ের আহত যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।জুলাই আন্দোলনে আমরা যারা জড়িত ছিলাম বিভিন্ন ভাবে তারা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।

ওয়াসিম আকরাম নামে আরেক জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী নেতা বলেন, সম্প্রতি আমরা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি ভুয়া আহত জুলাই যোদ্ধা গেজেটভুক্ত হয়েছে। দেবীগঞ্জে মুলত ৪ আগস্ট মারামারি হয়। এতে কয়েক জন আহত হয়, তাদের তালিকা রয়েছে। ৫ আগস্টেও কোন অপৃতিকর ঘটনা ঘটে নি। তবে এর পরে অনেকে বিভিন্ন ভাবে আহত হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। যারা এই তালিকা করেছে সেই কমিটি যদি জুলাই বিপ্লবের সম্মুখ সারির যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের কাছে তথ্য নিয়ে তালিকা করতো তাহলে আরো ভালো হতো।

এদিকে অভিযুক্ত জুবায়েরের আহত হওয়ার বিষয়ে দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, জুবায়ের সহ মোট দুই জন ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

এবিষয়ে দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. আবু নোমান মো: ইফতেখারুল তৌহিদ বলেন, আমরা আমাদের রেজিস্টার্ড খাতা চেক করে দেখেছি ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট দুপুর ১২ টা ২০ মিনিটে জুবায়ের নামে একজন বাম হাতে আঙুল ও মাথায় আঘাত নিয়ে ভর্তি হন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জুলাই বিপ্লবে আহতদের তালিকা যাচাই করতে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে স্থানীয় দুই সমন্বয়ককে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আহতদের চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন পক্ষের অভিযোগ, ওই দুই ছাত্র প্রতিনিধি ৬ আগস্ট পর্যন্ত কারাগারে থাকায় যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া পুরোপুরি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি, আর সেই পরিস্থিতিতে জুবায়ের ইসলামের নামও জুলাইয়ের আহত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

এ বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কমিটির ছাত্র প্রতিনিধি ওয়াসিস আলম বলেন, আমাদের কাছে যে তথ্য ছিলো দেবীগঞ্জ আওয়ামী ফ্যাসিস্ট মুক্ত হয় ৪ আগস্ট এবং আমরা কারামুক্ত হই ৬ আগস্ট। তার মেডিকেল কাগজপত্র অনুযায়ী সে ৬ আগস্ট আহত হয়। আমাদের মনে হয়েছিল যেহেতু সে জুলাই যোদ্ধা সেহেতু সে আহত হতে পারে। অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের এটা যাচাই করার সুযোগ হয়নি।

সেই কমিটির আরেক ছাত্র প্রতিনিধি খালিদ মাহমুদ সৈকত বলেন, আমরা যখন কারাগার থেকে আসি তখন আহতদের ভেরিফাই করার সময় তাকদীর (জুবায়ের) আমাদের কাছে কিছু তথ্য গোপন করেছিলো। তথ্য গোপন করেই সে জুলাই আহত যোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত জুবায়ের ইসলামের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তার এ সংক্রান্ত একটি কথোপকথনের অডিও হাতে আসে প্রতিবেদকের কাছে। অডিওতে জুবায়ের দাবি করেন, তিনি কাউকে অনুরোধ বা যোগাযোগ করেননি, সরকার নিজ উদ্যোগে তালিকা করেছে। তিনি বলেন, ৬ আগস্ট আহত হওয়ার তথ্যই তিনি জানান এবং সেটি মেডিকেল রিপোর্টেও উল্লেখ ছিলো।

এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহমুদুল হাসান বলেন, তার যোগদানের আগেই কমিটি যাচাই-বাছাই করে তালিকা পাঠিয়েছে। কমিটিতে সম্ভবত স্থানীয় তিন সমন্বয়ক ছিলেন, যারা নাম প্রস্তাব করেছেন। তিনি জানান, কেউ আহত না হলেও তালিকায় থাকলে তার নাম বাতিলের প্রস্তাব পাঠানো হবে।

Share This Article