আজকের মৌলবাদীরাই আগামী দিনের জঙ্গি

আজিমুল রাজা চৌধুরী

পৃথিবীর যত দেশে ধর্মীয় জিহাদী জঙ্গিদের উত্থান হয়েছে, তাদের মূলে ছিল মৌলবাদীতা। মৌলবাদীরা সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠে জঙ্গিতে। মৌলবাদ যখন জঙ্গি চেহারা নেয়, তখন সেটা কেমন নৃশংস হতে পারে, তার প্রমাণ নতুন করে দিতে হবে না। পার্শ্ববর্তী দেশ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টি দিলেই সহজে বুঝতে পারবেন।
আর বাংলাদেশের পরবর্তী রূপ হতে হয়তো-বা আর বেশি দেরি না। শতকরা ৯০℅ মুসলিমদের দেশ বাংলাদেশে এই মৌলবাদীরা শক্তিহীন না শক্তিবান, সেটা বর্তমান সময়ের নানা কার্যকলাপ প্রমাণ বহন করে।

ইদানিং বহু মৌলবাদী বক্তারা এত জোরে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের ঘোষণা দিতেছেন যা দেখে অবাক হব না।
কারণ, এদের লালন-পালন করে আমাদের রাজনৈতিক বড় শক্তিগুলো। এরা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট ব্যাংক। দেশের রাজনীতিহীনতার সুযোগে উগ্র, ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী শক্তি আবারও সক্রিয় হচ্ছে। কারণ, ধর্মীয় রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুবিধা এখন তারাও ভোগ করছে।

ধর্মীয় উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ যে গ্রামে কিংবা শহরে আধিপত্য তৈরি করে বসে আছে সে এলাকায় কার্ল মার্কস, লেনিন কিংবা কমিউনিজমের বাণী প্রচার করতে গেলে আপনার কী অবস্থা হতে পারে? অথবা সেই গ্রামে আপনি যদি বিজ্ঞান আন্দোলন, যুক্তিবাদী সমিতি অথবা নারীমুক্তি আন্দোলন করতে যান, তাহলে কী হবে? জঙ্গিরা কি আপনার এই মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার মেনে নিবে? আপনাকে তত্ত্বগতভাবে মোকাবিলা করবে? নাকি আপনাকে কতল করবে? বাংলাদেশে যেভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ গ্রাম-শহরে বিস্তার লাভ করছে, তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এই অপশক্তি গোটা বাংলাদেশের মানুষকে একটা বার্তা দিতে চাইছে। সেটি হলো, আগামী দিনের বাংলাদেশে রাজনীতির বিকল্প শক্তি তারাই। অন্য কেউ নয়। লোকবল, অর্থবল, অস্ত্রবল, ভোটের বল, বিদেশি শক্তির বল সব বিচারেই এরা আজকের বাংলাদেশে এক তৃতীয় শক্তি। এই সত্যি কেউ মানুক বা না মানুক। তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না।

গত কয়েক বছরে হেফাজতসহ অন্যান্য ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনের কর্মী সমর্থকেরা ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চট্টগ্রামসহ সারা দেশে যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তার ভেতর দিয়ে তারা জানান দিয়েছে যে, এটি তাদের ঘোষিত এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে তাদের প্রতিপক্ষ কে ছিল? হামলার ভিকটিমদের দিকে তাকালেই প্রতিপক্ষ চেনা যাবে। এই ধর্মীয় উগ্রবাদী বা জঙ্গিবাদীদের হামলার ভিডিও ক্লিপগুলো দেখুন। তাদের মিছিল কিংবা অন্যান্য প্রচারণার ছবি, নিউজ ক্লিপগুলো দেখুন। যুদ্ধটা কাদের বিরুদ্ধে সবকিছু পানির মতো সাফসুতরো দেখা যাবে। প্রামাণ্য দলিল সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই উগ্র ধর্মীয় তাণ্ডবে আক্রান্ত হয়েছে মুক্তচিন্তার ব্লগার, সংগীত বিদ্যালয়, বইয়ের দোকান, হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, বিভিন্ন ভাস্কর্য, কাদিয়ানী সম্প্রদায়সহ আরও অনেক কিছু।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অর্থনৈতিক রেমিট্যান্সের সঙ্গে আসা ‘সাংস্কৃতিক রেমিট্যান্স’ তাদের আদর্শকে শক্ত ভিত্তি দিচ্ছে। শুধু রাজাকার-আলবদর তকমা দিয়ে এই শক্তিকে বিচার করলে মস্ত ভুল হবে। এরা এখন প্যান ইসলামিক রেনেসাঁর অথবা গ্লোবাল ইসলামিক খিলাফত আন্দোলনের অংশ। এদের অনুসারী তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ কোনদিন দেখেইনি। ইউটিউবের লাখ লাখ ভিউ সমৃদ্ধ ওয়াজের ভিডিও কিংবা ফেসবুকের লাইভ স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে এদের মতাদর্শ এখন কোটি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। এই বিশাল গণযোগাযোগের একটা রাজনীতি আছে। প্ল্যান অফ অ্যাকশন আছে।

হেফাজত, জামাতের যৌথ হামলার তাণ্ডবে সিপিবি কেন্দ্রীয় অফিসই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়। মৌলবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদে মুক্তচিন্তার ব্লগারদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হলি আর্টিজানের মতো ঘটনা ঘটে। সার্বজনীন সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার বদলে হাজির হয় উগ্র ধর্মবাদী শিক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক সিলেবাস। নির্বাসিত লেখিকা তাসলিমা নাসরিন উগ্রবাদের এই বিপদ সম্পর্কে বহু আগে জাতিকে সতর্ক করেছিলেন। ভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়ায় তিনি বেঁচে আছেন কিন্তু লেখক হুমায়ূন আজাদ, অভিজিৎ রায়, তন্ময়, রাজিব, অনন্ত বিজয়, নিলাদ্রি’সহ অনেকের নির্মম মৃত্যু আমাদের সবার জন্য এক শেষ সতর্ক ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে গেছে।

ছবি : লেখক

এক বিরাট প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেছে। আগামীর বাংলাদেশ আদর্শগত এবং সাংস্কৃতিকভাবে কাদের দখলে থাকবে? আধুনিক মুক্তচিন্তার মানবতাবাদীদের নাকি মধ্যযুগীয় ভাবধারার হাতে? উগ্রবাদী মৌলবাদীদের সমাবেশে ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে যেসব জেহাদি ছবি সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তার রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক।

বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তিগুলো বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়াহ আইন জারি করার দাবি করে আসছিল। এই শরিয়াহ আইনের মধ্যে অন্যতম ছিল ব্লাসফেমি আইন। অর্থাৎ যারা ধর্মের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করবে, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার যে বিধান, সেটি তারা কার্যকর করতে চাচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন কর্মসূচী পালনকারী ইসলামী আন্দোলন দল ইসলামী শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের কথাও বলছে। আর এটি তাদের ঐক্যের একটি অভিন্ন প্লাটফর্ম হিসেবে মনে করছে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো। এসব দাবি-দাওয়ার সঙ্গে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর দাবির সঙ্গে অনেকটাই সাদৃশ্য আছে, যাতে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো গোপনে উগ্র মৌলবাদীদের সঙ্গে জোটবন্ধ হয়ে কাজ করছে।

হেফাজত গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের ওপর হস্তক্ষেপ করছে। পাঠ্যপুস্তকে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে ইস্যুগুলো আছে, সেগুলোকে বাদ দেওয়ার একটি পরিকল্পিত নীলনক্সা বাস্তবায়ন করেছে হেফাজত। এসব কারণে সরকারও সমালোচনার স্বীকার। এটা এই সফল সরকারকে বিপদে ফেলার পথ তাদের। এখন পাঠ্যপুস্তকগুলো আরও মৌলবাদী কায়দায় ঢেলে সাজানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করছে এই মৌলবাদী গোষ্ঠী। আশা করব, সরকার কঠোর হস্তে তা দমন করবে।

মৌলবাদীতা থেকে জঙ্গিবাদিতার সৃষ্টি। নতুন প্রজন্মের মধ্যে যে ধর্মান্ধতা মৌলবাদীরা ঢুকিয়ে দিয়েছে বা দিচ্ছে, তাতে যেকোন সময় বিস্ফোরিত হয়ে জঙ্গিবাদি রাষ্ট্রে বাংলাদেশ যুক্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া আমাদের দেশের মৌলবাদীরা পূর্বে তালেবানদের পক্ষ নিয়ে আফগানিস্তানে তাদের ভাষায় জিহাদ করেছে।
এখন যেহেতু আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায়, তাই তাদের কার্যক্রম আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়াই স্বাভাবিক।
মুক্তচিন্তার মানুষরা হয় মুখ বন্ধ রাখবে নতুবা দেশ ত্যাগ করবে। আর এই দুই না করতে পারলে মৌলবাদীদের হাতে খুন হতে হবে, এটাই যেন নিয়তিতে পরিণত হচ্ছে।

আজিমুল রাজা চৌধুরী
লেখক ও ব্লগার

Share This Article