‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ এই স্লোগানে বলিয়ান কিছু মানুষ শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেও বাস্তবতার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন যুবসমাজ তথা মানবসেবায়। আবার কিছু কিছু দুঃখী মানুষের দুঃখে পীড়িত হন। দুঃখী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য সমাজ ও দেশের মাঝে রাখেন অনন্য অবদান। সে রকমই একজন যুবক মো: আমিনুল হক সাদী। সবাই যাকে যুব-সংগঠক আমিন সাদী হিসেবে চেনেন। মানবকল্যাণে নিবেদিত এক উদীপ্ত যুবক তিনি।
কিশোরগঞ্জের সফল যুব-সংগঠক আমিন সাদী যুব-সংগঠক হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তিনি ২০০৪ সালে ‘কিশোরগঞ্জ যুব-উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ হতে গবাদী পশু, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষ, গরু মোটাতাজাকরণ, কৃষিবিষয়ক ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্যান্য যুব ও যুব মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান তৈরির দিকে মনোযোগী হতে শুরু করেন। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগিয়ে একজন যুব-সংগঠক হিসেবে নিরলসভাবে কাজ শুরু করেন। যা এখনও চলমান আছে।
গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেও যুব-সংগঠক আমিন সাদী সরকারি চাকরির দিকে না তাকিয়ে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস থেকে প্রথম দফায় ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ‘সাদী সমন্বিত কৃষি খামার’ গড়ে তোলেন। এই খামারের পুকুরে মাছ চাষ, নিজস্ব জমিতে কৃষি ফসল ও বনায়ন নার্সারী তৈরি করেন তিনি।
এসবের পাশাপাশি শাক-সবজির আবাদ করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। আমিন সাদীর সবচেয়ে বড় সাফল্য হল নিজেকে একজন সফল যুব-সংগঠক হিসেবে গড়ে তোলা। যুব-উন্নয়ন অধিদফতর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকার বেশ কজন বেকার যুবককে ‘যুব-উন্নয়ন পরিষদ’র ছায়াতলে সংগঠিত করেন। বিভিন্ন অফিস-আদালতের মাধ্যমে বিশেষ করে ‘যুব-উন্নয়ন অধিদফতর’ থেকে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিয়ে সফল আত্মকর্মী হিসেবে গড়ে তুলেছেন তাদের। অনেকেই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে ঋণ নিয়ে আজ সাফল্যের শিখরে আরোহন করেছেন যারা কিনা আমিন সাদীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
আমিন সাদী বেকার জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ২০১০ সালে গড়ে তোলেন ‘যুব-উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি যুব-সংগঠন। এ সংগঠনটির মাধ্যমে বেকার জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করে চলেছেন তিনি। এ সংগঠনের মাধ্যমে এলাকার দরিদ্র বেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় আড়াই হাজার যুব ও যুব মহিলাকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতরের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলেছেন। অনেকেই প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। স্থানীয় বেকার যুবকরা প্রশিক্ষণ পেয়ে পোল্ট্রি ফার্ম তৈরিকরণসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের সফল হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
করোনাকালে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘যুব-উন্নয়ন পরিষদ’র মাধ্যমে সংগঠনের উদ্যোগে সহস্রাধিক লোককে বিনামূল্যে করোনার টিকার রেজিষ্ট্রেশন করে দিয়েছেন। মাস্ক, হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন। দারিদ্রদের আর্থিক সহায়তাসহ অনেক মানবিক কাজ করছেন। জেলার অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও যুব-সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
২০০৬ সালে আমিন সাদী নিজ গ্রামে গড়ে তোলেন ‘মহিনন্দ ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ’ নামে আরও একটি সংগঠন। সমাজসেবা অধিদফতর থেকে নিবন্ধিত হয়ে সংগঠনটির উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবামূূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুলভাবে প্রশংসিত হন এবং বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১১ সালে গড়ে তোলেন ‘মহিনন্দ ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পাঠাগার’ নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে জ্ঞান অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে। চতুর্দিকে আলোর বিকিরণ ছড়িয়ে দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। ২০২০ সালে এ পাঠাগারটি জেলার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ পাঠাগার হিসেবে জেলা প্রশাসন থেকে সম্মাননা পদক পেয়ে আরও সুনাম কুড়িয়েছেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় গ্রন্থাগার অধিদফতরের মাধ্যমে মুজিববর্ষে একটি ‘মুজিববর্ষ কর্ণা’র উপহার পেয়ে একে আরও সুভোসিত করে তুলেছেন তিনি।
২০১৯ সালে আমিন সাদী গড়ে তোলেন ‘কিশোরগঞ্জ আর্কিওলজিক্যাল সোসাইটি’ নামে আরও একটি সংগঠন। যার মাধ্যমে জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তির উন্নয়ন ও সংরক্ষণে অবদান রেখে যাচ্ছেন তিনি। ২০২১ সালে গড়ে তোলেন ‘বয়স্ক ও যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’। এ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বয়স্কদের শিক্ষাদান ও বেকার যুব সম্প্রদায়কে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের সদস্যরাও আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠানসমূহের নিবন্ধন দিয়ে ‘যুব-উন্নয়ন অধিদফতর’, ‘সমাজসেবা অধিদফতর’ ও ‘গণগ্রন্থাগার অধিদফতর’ আমিন সাদীর কার্যক্রমকে আরও সম্প্রসারিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। এসব প্রশংসনীয় কার্যক্রমে আমিন সাদী পেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শতাধিক সম্মাননা সনদ ও পুরস্কার।
ইতোমধ্যে আমিন সাদী ‘শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনিস্টিউট, সভার, ঢাকা’ থেকে যুব-বিনিময় কর্মসূচিবিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে গত ২৭ জুন থেকে ১ জুলাই ২০২২ ইং, ৫ দিনব্যাপী দেশের ৬৪টি জেলা থেকে আগত যুব-প্রতিনিধিদের নিয়ে যুব-মিনিময় কর্মসূচিতে কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে অংশগ্রহণকারী যুব-সংগঠক হিসেবে তিনি অন্যতম হয়েছেন। সেরা দশে তৃতীয় বক্তা হিসেবে ‘শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনিস্টিউট’ কর্তৃপক্ষ তাকে পুরস্কার প্রদান করেছে। যুব উন্নয়ন অধিদফতর কর্তৃক প্রশিক্ষণ বিষয়ের বাস্তব অভিজ্ঞাতার আলোকে কিশোরগঞ্জ জেলা, উপজেলাসহ তৃণমূল পর্যায়ে বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য আত্মকর্মী ও সাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছেন।
“বাংলার মানুষ বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে না, সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারে না” আমিন সাদী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই উক্তিকে হৃদয়ে লালন করেন। তিনি এ কথার প্রতি আকৃষ্ঠ হয়ে ইতিহাস ঐতিহ্যর প্রতি মনোনিবেশ হন। গোপালগঞ্জ সফরে গিয়ে অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হয় তার। পরে লিখে ফেলেন ‘যেমন দেখেছি রাষ্ট্রপতির কিশোরগঞ্জ, প্রধানমন্ত্রীর গোপালগঞ্জ’ শিরোনামে একটি বই। এছাড়া আরও তিনটি বই প্রকাশ হয়েছে তার।
আমি সাদী বলেন, ‘আমার পথচলাটা ছিল খুবই কঠিন পরিস্থিতিতে। নানা প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে আজ এক যুগে পা দিয়েছে আমার ‘যুব উন্নয়ন পরিষদ’টি। সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যাদের সহায়তা পেয়েছি, তারা হলেন যুব উন্নয়ন অধিদফতরের সাবেক উপপরিচালক মো: রোকন উদ্দিন ভূঞা, বর্তমান উপপরিচালক ফারজানা পারভীন, সহকারী পরিচালক তাহসীনা নাজনীন, সদর উপজেলার যুব-উন্নয়ন কর্মকর্তা জেড এ সাহাদাৎ হোসেন, সহকারী যুব-উন্নয়ন কর্মকর্তা মো: সিদ্দিকুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের ব্যক্তিবর্গ।’
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিনন্দ ইউনিয়নের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. মনসুর আলী আমিন সাদী সর্ম্পকে বলেন, ‘আমাদের জানামতে, তিনি ছোট বেলা থেকেই বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সামাজিক কার্যক্রমে জড়িয়ে আছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতায় স্থানীয় ও দেশের জাতীয় অনেক সংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে সফলতার সাথে কাজ করে আসছেন। বহু প্রতিভাধর যুব-সংগঠক আমিন সাদীর কৃতিত্বের জন্য তাকে আমাদের সংগঠন ও পরিষদের পক্ষ হতে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। তার প্রতিষ্ঠিত যুব-সংগঠনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এতদঞ্চলের বেকার জনগোষ্ঠীর আত্মসামাজিক উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখে যাচ্ছে। এই প্রতিভাধর সংগঠককে জাতীয়ভাবে পুরস্কার দেওয়া হলে তিনি আরও উৎসাহিত হতেন।’
জাতীয় যুব-পদক-২০২০ প্রাপ্ত শিবলী সাদিক নোমান বলেন, ‘২০১৮ সালে সাদী ভাইয়ের যুব সংগঠনের সহায়তায় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা যুব-উন্নয়ন অধিদফতরের উদ্যোগে অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমি নিজেও মৎস্য ডেইরি ও পোল্ট্রিফার্ম প্রতিষ্ঠা করি। যেটি জেলা প্রশাসন ও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদল পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করে আমাকে জাতীয় যুব-পদকে ভূষিত করে।’
কিশোরগঞ্জ সদরের মহিনন্দের বাসিন্দা শ্রেষ্ঠ সফল আত্মকর্মী জাতীয় যুব-পদক ২০১৩ প্রাপ্ত নুরুল আরেফিন লিংকন বলেন, ‘যুব-সংগঠক আমিনুল হক সাদী আমার ফার্ম নিয়ে অনেক প্রতিবেদন তৈরি করে এলাকার বেকার যুবদের মধ্যে পোল্ট্রি শিল্পের প্রসারে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত যুব সংগঠনের প্রশিক্ষিত সদস্যরা আমার ফার্মে এসে হাতে কলমে শিক্ষা নিয়ে তারা স্বাবলম্বী হয়েছেন। দক্ষ যুব-সংগঠক আমিনুল হক সাদীকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা এখন সময়ের দাবী।’
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা যুব-উন্নয়ন কর্মকর্তা জেড এ সাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘যুব-সংগঠক আমিনুল হক সাদীর প্রতিষ্ঠিত যুব-উন্নয়ন পরিষদকে আমরা নিবন্ধন দিয়েছি। তার সংগঠনের উদ্যোগে জাতীয় যুব দিবসসহ বিভিন্ন প্রশংসনীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।’
কিশোরগঞ্জ যুব-উন্নয়ন অধিদফতরের উপপরিচালক ফারজানা পারভীন বলেন, ‘যুব-সংগঠক আমিনুল হক সাদীর প্রতিষ্ঠিত যুব-উন্নয়ন পরিষদ নামের সংগঠনটি একাধিকবার পরিদর্শনে গিয়েছি। সে মুজিববর্ষে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের যুবশক্তি বিষয়ে রচনা লিখে প্রথমে সদরে প্রথম হয়। পরে জেলা পর্যায়েও প্রথম স্থান লাভ করায় যুব-উন্নয়ন অধিদফতর থেকে তিন হাজার টাকার প্রাইজবন্ড, ক্রেষ্ট এবং সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়েছে।’
আমিনুল হক সাদী কিশোরগঞ্জ তথা স্থানীয় বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের কাছে একজন অনুপ্রেরণার নাম। সাদীর সার্বিক সফলতা কামনা করেছেন স্থানীয়রা। তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় যুব-পদকে তাকে ভূষিত করার জোর দাবী জানিয়েছেন সচেতন মহল।
মোহাম্মদ অংকন : লেখক, কলামিস্ট ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।