
আরবি শব্দ সিয়াসাত, যার বাংলা অর্থ রাজনীতি। সিয়াসাত আরবি শব্দ হওয়ায় আমাদের উপমহাদেশে রাজনীতি শব্দই ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ হলো কুরআন-হাদিস নির্দেশিত রাষ্ট্রনীতি, জনগণের বিষয় সমাধান করা, বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা এবং ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিচক্ষণতার সাথে উপায় বের করা, যে কোন ধরনের দুর্নীতি ও বৈষম্য পরিহার করে চলা।
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যে রাজনীতি, সেটিই মূলত ইসলামি রাজনীতি। ইসলাম ধর্মের উত্থানের পেছনে ধর্মীয় আন্দোলনের চেয়ে রাজনৈতিক অবদানই বেশি ছিল। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক প্রয়োজনেই ধর্মীয় বিষয়গুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। বাঙালীরা ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর বলেই ধর্মের দোহাই দিয়ে যুগে যুগে বিভিন্ন অপকর্ম ঘটেছে। কেউ কেউ ভন্ডামীর মাধ্যমে পীরের বেশ ধরে, ধর্মীয় দু-চারটা ভালোকথা কথা বলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। আবার অনেকেই ধর্মকে পুঁজি করে রাজনৈতিকভাবে স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছে। ধর্মের দোহাই দিলেও প্রায় সকলেরই লক্ষ্য থাকে নিজের আখের গোঁছানো।
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। দলগুলোর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য শরিয়াভিত্তিক সমাজ গঠন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন ও সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার কথা থাকলেও অনেক দলই ধর্মীয় কথা প্রচারের চেয়ে নিজের দলের কথা প্রচারেই অধিক মনোযোগ দেয়। ধর্মকে পুঁজি করেই মূলত রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় কতিপয় কিছু দল। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রয়োজনেই বড় দলগুলোর সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে তারা। অনেক দলগুলোই সুযোগ-সুবিধার রাজনীতির দিকেই ঝুঁকে পড়ে। নিবন্ধিত ইসলামি ধারার দলগুলোর সংখ্যা ১০টি হলেও, এক বা দুইজন হুজুরকে কেন্দ্র করে প্যাড-সর্বস্ব অসংখ্য ইসলামি দল গজিয়ে উঠেছে। জনসমর্থন তেমন না থাকলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জোটগঠনে দলগুলোর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। দলগুলোর প্রধান হুজুরদের ধর্মীয় সভা বা মাহফিলে মানুষের উপস্থিতির সংখ্যাকেই জনসমর্থন হিসেবে চালিয়ে দিতে চান তারা।
অনেকাংশেই দেখা যায়; কোনো কোনো দলের প্রধান হুজুরদের মুরিদ সংখ্যা কয়েক লক্ষাধিক হলেও কার্যত ভোটের সময় দলগুলো সেভাবে ভোট পায়না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, ভোটের মাঠে এখনও দলগুলো সেভাবে আস্থার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি হিন্দুদের মাঝে নিজেদের আস্থা অর্জন করতে পারলেও বাংলাদেশী ইসলামি দলগুলো মুসলমানদের আস্থা অর্জন করতে সেভাবে সক্ষম হয়নি। সে কারণে সেভাবে কোনো ভোট ব্যাংকও গড়ে উঠেনি।
রাজনীতির বিপরীতে আরেক প্রকার রাজনীতি আছে। যা হচ্ছে সিয়াসাহ জালিমা তথা মিথ্যাচার, ধোঁকাবাজি, সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতারণা। বর্তমান সময়ে রাজনীতির বিপরীত দিকটাই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো চলছে রূপক ও অন্তঃসারশূন্য নীতির ভিত্তিতে। এভাবেই সাধারণ জনগণকে পরিবর্তনের কথা শুনিয়ে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কর্মপন্থা পরিচয় দেয়, তারা দুর্নীতির পেছনে ছুটছে এবং তাদের তাদের রীতি-নীতি, পন্থা ও কর্মে ন্যায়পরায়ণতা ও বিচক্ষণতার কোন লক্ষণ সেভাবে দেখা যায় না। প্রকৃতপক্ষে তারা মুখোশের আড়ালে তাদের অশুভ উদ্দেশ্যকেই হাসিল করতে চায়।
প্রকৃতঅর্থে রাজনীতি ইসলাম থেকে আলাদা নয়। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতির নামে যে মিথ্যা, প্রতারণা, চরিত্রহননের খেলা সেটা ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ইসলাম কখনও এরূপ রাজনীতির সাথে সম্পর্ক রাখে না। ইসলামের নবীগণ যুগ যুগ ধরে তাগূতী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রামের করেছেন। নমরুদের বিরুদ্ধে হযরত ইবরাহীম (আ.), ফিরআউন ও কারূনের বিরুদ্ধে হযরত মূসা (আ.) এবং স্ব স্ব যুগের কুফরি ও শিরকের বিরুদ্ধে নবীগণের সংগ্রাম প্রমাণ করে নবীগণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন। মদিনার সনদ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় বহন করে। তার প্রণীত সনদ নাগরিক সাম্যের সুমহান নীতি, আইনের শাসন, ধর্মের স্বাধীনতা ও ধর্মীয়সহিষ্ণুতাকে নির্দেশ করে।
আমাদের প্রত্যাশা ইসলামি দলগুলো নিজেদের মাঝে দলাদলি, চরিত্রহনন বাদ দিয়ে প্রকৃতঅর্থেই রাজনৈতিক চর্চা করুক। সমাজ থেকে অন্যায়-অনাচার, ব্যভিচার, চুরি-ডাকাতি, জুলুম – অত্যাচার, দখলদারিত্ব, লুটপাট, গুম-খুন, অনৈতিকতা-অপকর্ম হতে সমাজকে রক্ষা করতে প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহন। মাহফিল কেন্দ্রিক বা ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতির ব্যবহার বন্ধ করে বৃহত্তর জনসাধারণের কল্যাণে ইসলামী দলগুলোর রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হোক এই আমাদের প্রত্যাশা।
শেখ রিফাদ মাহমুদ, উপদেষ্টা পর্ষদ সদস্য, গ্লোবাল স্টুডেন্ট ফোরাম।