শেষ মুক্তির আগের আত্মকথন


রাশিদুল ইসলাম প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৩০, ২০২২, ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ /
শেষ মুক্তির আগের আত্মকথন
শেষ মুক্তির আগের আত্মকথন

পৃথিবী যে অসুখে ভুগছে সেই অসুখ আমাকেও পেয়ে বসেছে আজকাল।দীর্ঘদিন হয়ে এলো আমি প্রাণখুলে হাসতে পারিনা।কিংবা আমার হাসির আড়ালের অভিনয় দেখে আমি নিজেই মাঝে মাঝে শিউরে উঠি।আশ্চর্য!ওই গল্প, নাটক-সিনেমার চেয়েও আমার অভিনয় বেশি জটিল মনে হয়।বেঁচে থাকতে আমাকে অভিনয় করতে হয়।জগত তাদের তৈরি জটিল নিয়ম আমার উপরেও চাপিয়ে দিয়েছে।তারা আমাকে যান্ত্রিক বানিয়ে দিয়েছে।তারা বুঝিয়েছে পৃথিবীতে বাঁচতে হলে অভিনয় জানতে হয়,প্রতিনিয়ত লড়ে যেতে হয়,তাদের মতো হয়ে যেতে হয়।না হলে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যেতে হয়।প্রাণবন্ত সবুজ পৃথিবীটাও হঠাৎ ধূসর ছায়ায় ঢেকে যেতে থাকে।

আজ অফিস বন্ধের দিন।সপ্তাহের এই দিনটাতে আমি বিকেলে হাঁটতে বের হই।দম বন্ধ কাজের ব্যস্ততার মাঝে আমার মনে হয় সপ্তাহের এই একটা দিনই আমার কাছে মুক্তির দিন।অথচ মুক্তির দিনটাতে আমি আর মুক্তি খুঁজে পাইনা।

তবুও আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি।মুক্তির আশায় আমি ছটফট করি।অন্তত চারদেয়ালের মাঝ থেকে আমি বের হই।আমি খোলা শহর দেখতে যাই,আমি দু’হাতে মুক্ত আকাশ ধরতে যাই।যদি কোনোভাবে মুক্তি এসে ধরা দেয় আমায়!

এখন অগ্রহায়ণ মাস।দক্ষিণ গোলার্ধে হেলে থাকা সূর্য থেকে তীর্যকভাবে আলো পড়ছে পৃথিবীর এই অংশে।তবে উত্তাপ কম।শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে।সন্ধ্যা হলেই ইট পাথরের শহরে লুকিয়ে থাকা ঘাস,লতাপাতাগুলোতে নিড় জমে।তারা জানান দেয় শীতের আগমনী বার্তা।

হাঁটতে হাঁটতে হাতিরঝিলের এদিকেই আসা হলো।

কোলাহলময় শহরে এই একটা জায়গাই আমার কাছে মুক্তির আনন্দ দেয়।এখানে খোলা আকাশ আছে,ঝিল আছে,ঠান্ডা বাতাস আছে, আবার ধুলাবালি আর হর্ণের শব্দও এখানে কম।

চারপাশে সবুজের কিছু সমারোহ দেখা যায়।আমি আমার দুচোখের শহর দেখতে দেখতে হাঁটতে থাকলাম।

আজকের দিনটাতেও ব্যতিক্রম কিছু নেই।ওই একইরকম দেখতে মানুষেরাই চারপাশে ছুটোছুটি করছে।বেঁচে থাকতে কত আয়োজন তাদের।কিন্তু দেখতে একইরকম হলেও প্রতিটা মানুষই যেন আলাদা।সবার মাঝেই আলাদা আলাদা গল্প।

আসলে আমাদের সবারই এক একটা আলাদা পৃথিবী থাকে। আমরা সবাই-ই সেই আলাদা পৃথিবী নিয়েই বাস করি।সেখানে যেমন সহজে কাউকে প্রবেশ করতে দেইনা আবার কাউকে বাহির করে দিতেও আমাদের দেয়াল ভাঙ্গার খেলা খেলতে হয়।আর সেই পৃথিবীতে একমাত্র রাজাও কিন্তু আমরাই!

ছুটির এই দিনে এখানে মুক্তমনা মানুষদের ঘুরাঘুরি বেশি।শেষ বিকেল কিংবা গোধূলির রং মাখতে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদেরই এখানে দেখা যায়।অনেকেই শরীরচর্চা করতে আসেন।অনেকেই প্রিয়জনের সঙ্গে হাঁটতে বের হোন একান্ত সময় কাটাতে।শিশুরা দল বেঁধে সাইকেল নিয়েও বের হয়।

বেশিরভাগ মানুষই সম্ভবত মুক্তির স্বাদ নিতেই এখানে আসে।কেউ কেউ পায়ও মনে হয়।তবে সেটা আপেক্ষিক মুক্তি।সত্যিকারের মুক্তি নিশ্চয়ই নয়।

সাত-আট বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে আসতে দেখলাম।সে ফুল বিক্রি করছে।বাম হাতে একগুচ্ছ ফুল থেকে ডান হাতে একটা নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে মানুষদের দিকে। আমি তাকে ডাকলাম।জিজ্ঞেস করলাম এই তুমি কি জানো মুক্তি কি?সে হাসলো,বললো,ভাইয়া ফুল নেন,দশ টাকা।আমি ভাবলাম সম্ভবত ফুল বিক্রি করতে পারাটাই তার কাছে মুক্তি।এক একটা ফুল বিক্রি করতে পারা তার কাছে এক একটা মুক্তির আনন্দ দেয়।আমি একটা ফুল নিয়ে নিলাম।আবারও হাঁটতে থাকলাম।

একটু এগিয়ে যেতেই ফুটপাতে এক অসহায় নারীকে বসে থাকতে দেখলাম।পাশে তার পাঁচ-ছয় বছরের মেয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।ময়লা গায়ে শ্যামলাবরণ চেহারা তার।অথচ কি অদ্ভুত সুন্দর দেখতে সে।যেনো পুরো যান্ত্রিক,রোবোটিক এই রাজ্যের একমাত্র রাজকন্যা।অথচ পৃথিবী তাকে রাজমহল দিতে পারেনি।তাকে তার রাজত্ব থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে।

সে আমার হাতের ফুলটির দিকে তাকিয়ে আছে।এবং হাতও বাড়িয়ে বসলো।আমি ফুলটি তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।সে ফুল হাতে নিতেই খুশিতে তার আম্মুর দিকে দৌড়ালো।চারপাশে আনন্দে ছুটে বেড়াতে লাগলো।আমার হঠাৎ মনে হলো সে যেন খোলা আকাশে উড়ে বেড়ানো একটা ছোট্ট মুক্ত পাখি।

পাখির কথা ভাবতেই আমি আকাশের দিকে তাকালাম।দেখলাম ওই দূর আকাশে কিছু শঙ্খ চিল ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি এবার হঠাৎ মুক্তি খুঁজে পেলাম।এইযে একমাত্র পাখিরাই সম্ভবত মুক্তির আনন্দ পায়।তারা চাইলেই দু পাখা মেলে আকাশে উড়তে পারে।কি আনন্দ তাদের।আহা মুক্তির আনন্দ!

আবারও হাঁটতে থাকলাম।আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখি একটা ভিড় জমেছে।একটা ছেলে ও একটা মেয়ে ঝগড়া করছে আর তাদের চারপাশে কিছু মানুষ জড়ো হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।যেনো মজাদার কোনো সার্কাস চলছে সামনে।আমিও তাদের দলে যোগ দিলাম।

দেখলাম ছেলেটি বলছে,তুমি আমার সাথে এমন করতে পারোনা।তোমার এভাবে পরিবর্তন হয়ে যাবার কথা ছিলোনা।তুমি কেনো ভুলে যাবা আমায়?তোমাকে আমার সাথে আজীবন থাকার কথা ছিলো।

ওদিকে মেয়েটি বারবার একটা কথাই বলছে,ঠিক আছে আমি ভুল করেছি।কিন্তু আমি আর পারছি না।এবার আমায় মুক্তি দিন!

হাহা।এখানেও মুক্তি।তবে অন্যরকম মুক্তি।যেখানে সম্ভবত দু’জন নিজেদের ইচ্ছেতেই একে অপরের সঙ্গে বন্দী হয়েছিলো।অথচ আজ তাদের একজন মুক্তির নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে!

সেখান থেকে চলে আসলাম।পাশের টঙ্গের দোকানে এক কাপ রং চা খেতে বসলাম।একজন বয়স্ক মানুষকে দেখলাম।অদ্ভুতভাবে একপাশে একা বসে চা খাচ্ছে।দেখেই মনে হলো মানুষটা জটিল।ভয়ংকর আর্তনাদ ভরা তার দু-চোখ।কিন্তু তা প্রকাশ করার সামান্য আগ্রহও তার নেই।আমি বললাম আঙ্কেল কেমন আছেন?

তিনি এক পলক তাকিয়েই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন।কিছুই বললেন না।সম্ভবত জগত সম্পর্কে তার আগ্রহ কম।সে চারপাশের মানুষদেরও আর তেমন পছন্দ করেন না।কিছুক্ষণ পর তিনি চলে গেলেন।যাওয়ার পর চায়ের দোকানদার মামা আমাকে বললেন, উনি একটু এমনই অদ্ভুত মানুষ। পাশেই একটা বাসা আছে উনার।একটা ফ্লাটে একা থাকেন তিনি।সম্ভবত তিনি অবিবাহিত।কোনো আত্মীয় স্বজন আছে কিনা সেটাও জানিনা।একাকীত্বই তার নেশা।নিয়ম করে প্রতিদিনই এই সময় হাঁটতে বের হোন,চা খান।আবার চলে যান।

আমার মনে হলো এই মানুষটা হয়তো মুক্ত। তার জগতের প্রতি এখন আর কোনো মায়া নেই।কোনো ইচ্ছে,আকাঙ্খা নেই।সব যেন মরে গেছে।

অথচ আচমকা আমার মনে আবার প্রশ্ন জাগলো, তবে তার বেঁচে থাকার কি কারণ?কেনো তিনি বেঁচে থাকতে এখনো প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন?নাকি মৃত্যুের অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু তাকে ভাবায়ই না?এমন মুক্তি কি আসলেই মানুষকে মুক্তি দেয়?

উত্তর পেলাম না।আবারও হাঁটতে থাকলাম।শেষ বিকেল ফুরিয়ে প্রকৃতিতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।আলোকিত পৃথিবীটাকে কয়েক মুহুর্তেই অন্ধকার গ্রাস করে ফেলবে।প্রকৃতিতে এর চেয়ে বিশ্রী মুহুর্ত মনে হয় আর ঘটেনা।অথচ পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাওয়া পৃথিবীও কিন্তু আবার সুন্দর লাগে।পরের আলোকিত দিন দেখার অপেক্ষার মাঝে অন্যরকম সুন্দর খুঁজে পাওয়া যায়।

আমাদের জীবনটাও সম্ভবত এমনি।আলো আসে আবার অন্ধকারও আসে।কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই আমরা অন্ধকারে হারিয়ে যাই।আমরা না পরিবর্তন মেনে নিতে পারি আর না অপেক্ষা করতে পারি।পরিবর্তনের পরের পৃথিবীরও যে আলাদা স্বাদ আছে সেটা আমরা খুঁজতেই যাইনা।আমরা অনেকেই হেরে যাই!আমরা অনেকেই নিঃশেষ হয়ে যাই!আগের মতো আর উঠে দাঁড়াতে পারিনা!

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।আমি শেষবারের মতো আপেক্ষিক সূর্যের আলোয় অন্ধকার পৃথিবীটাকে আরেকবার দেখার চেষ্টা করলাম।আমি আকাশের দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ আগে আকাশে উড়ে বেড়ানো যে চিলগুলোকে আমি মুক্ত ভেবেছিলাম আমি তাদেরও ঘরে ফিরতে ব্যস্ত হতে দেখতাম।তারা তাদের সঙ্গীদের কাছে ফিরছে কিংবা সঙ্গীসহ তাদের সাজানো বাসায় ফিরছে।আমি দেখলাম তারাও মুক্ত নয়।আপেক্ষিক মুক্তির স্বাদ নিচ্ছিলো মাত্র!

আমার মনে হলো এখানে কারো মুক্তি নেই।যেমন আকাশে উড়ে বেড়ানো চিল কিংবা গাঙ্গের জলে ভেসে বেড়ানো বক দেখে ছোটোবেলা থেকেই আমাদের মুক্তির স্বাদ জাগতো এখানে তার কোনো অবকাশ নেই।পৃথিবী আমাদের বন্দীর সেরা আয়োজনগুলো আমাদের চারপাশে জমিয়ে রেখেছে।

আমি নিজের দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকালাম।নিজেই নিজেকে বলতে থাকলাম,মুক্তি চাও?আসলেই কি মুক্তি পাও?

চারপাশে তাকিয়ে দেখো তোমার উড়বার ক্ষমতা নেই।তোমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে।যেমন করে মানুষ ঘর সংসারেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে একদিন,এটা জানা সত্বেও যে সাজিয়ে রাখা এই আয়োজনও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে।তারপরেও তারা মুক্তি পায় না মুক্তির আগ পর্যন্ত!তোমারও মুক্তি নেই তেমন,বোকা!

প্রায় বিশ মিনিট হাঁটার পরে আমি কারওয়ান বাজার এলাকায় প্রবেশ করলাম।সিগনাল পড়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।এরইমাঝে কোথা থেকে একটা মধ্য বয়সী যুবক এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন।কিন্তু তিনি দাঁড়িয়ে না থেকে ব্যস্ত রাস্তা পার হতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।এক হাতে যানবাহনকে সতর্ক করতে করতে এবং আরেক হাতে কানে ধরে রাখা মোবাইলে কথা বলতে বলতে দ্রুত রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছেন।তিনি মাঝামাঝি চলে গেছে,হঠাৎ দ্রুতগামী একটা পিকআপ ভ্যান এসে মুহুর্তেই তাকে ধাক্কা দিয়ে পাশে ফেলে চলে যায়।আমি চারপাশে একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ পেলাম।একটা মুক্তির ঘ্রাণ।দেখলাম একটা মানুষের জগত থেকে মুছে যাওয়ার ভয়ংকর আয়োজনের দৃশ্য।

ব্যস্ত রাস্তায় একটা মানুষ কিছুক্ষণ আগেই জীবনের তরে ছুটে চলেছিলো,অথচ এখন মনে হচ্ছে সে শেষবারের মতো বায়ু থেকে একটু প্রশ্বাস নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।তার মাথার চারপাশে রক্তের বন্যা বয়ে চলছে।অল্প কয়েক মুহুর্তেই তার শরীরের সমস্ত অংশই যেনো নিশ্চুপ হয়ে পড়লো।শরীর থেকে কোনো উদ্দীপনা ব্রেইন আর নিতে পারছেনা।ওদিকে অক্সিজেনশূন্য মস্তিষ্ক নিজেই ধীরে ধীরে শান্ত হতে চলেছে।সে শেষবারের মতো পুরো জীবনের স্মৃতিগুলো ভেবে চলেছে।প্রায় সাত মিনিট পর তার ব্রেইনও এই জগতের সকল স্মৃতি,সকল গল্প,ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো।এই শহরে প্রতিনিয়ত বেজে চলা মিশ্র কোলাহলময় শব্দ তাকে আর কখনোই ভাবাবে না।

আমার হঠাৎ মনে হলো এইতো সে মুক্তি পেলো।যে মুক্তির জন্য আমাদের এতো আয়োজন,এতো ছটফট করা।পৃথিবী এবার বুঝি তাকে সত্যিকারের মুক্তি দিয়ে দিলো!

শিক্ষার্থী : সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com