- দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পরিবর্তনের নতুন ধারা
শেখ রিফাদ মাহমুদ
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের উষ্ণতা সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, পাকিস্তানের জন্য বাংলাদেশের ভিসা নীতির পরিবর্তন এবং সরাসরি বাণিজ্য রুট চালুর মতো পদক্ষেপ ভারতীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক পর্যায়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স শর্ত বাতিল করার সিদ্ধান্ত এবং করাচি-চট্টগ্রাম কার্গো চলাচলের অনুমতি এই দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। এই পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বেশ প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই জটিল ছিলো। তবে সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত করছে যে, উভয় দেশ নিজেদের স্বার্থে পারস্পরিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের দিকে এগোচ্ছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, যা দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগকে বেশ কঠিন করে তুলেছিল। কিন্তু এখন এই শর্ত তুলে নেওয়া হয়েছে, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে সহজ করছে।
দুই দেশের জটিল সম্পর্কের প্রভাব বাণিজ্যেও পড়েছে। যদিও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কখনোই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, তবে তা ছিল অত্যন্ত সীমিত। দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি কন্টেইনার জাহাজসেবার অভাব ছিল, যা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে, গত নভেম্বরে পাকিস্তান থেকে প্রথমবারের মতো সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ আসে এবং করাচি-চট্টগ্রাম কার্গো পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক-বানিজ্যিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে।
বাংলাদেশ সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে ২৫ হাজার টন উচ্চমান সম্পন্ন চিনি আমদানির চুক্তি করেছে। আগামী মাসে করাচি বন্দর থেকে এই চিনি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। প্রায় কয়েক দশক পর পাকিস্তান থেকে এত বড় পরিমাণ চিনি কিনছে বাংলাদেশ। এর আগে, চিনি আমদানির প্রধান উৎস ছিল ভারত। তবে এবার ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান থেকেও সংগ্রহ করছে, যা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের নতুন দিক উন্মোচন করছে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন শুধু দুই দেশের জন্যই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। পাকিস্তানি বাজার বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্পের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এর পাশাপাশি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে কৃষি ও খাদ্যপণ্যের আমদানির পথ সুগম হতে পারে। তবে এই সম্পর্ক উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য ভারতের তুলনায় আরও স্বাধীন হয়ে উঠবে, যা ভারতের জন্য বেশ অস্বস্তিকর বটে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ
ভারত দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একক প্রভাব বিস্তারকারী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশও ঐতিহাসিকভাবে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। তবে সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে বাংলাদেশ আর ভারতকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে আগ্রহী নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়ন, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বলে ভারতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছে।
তারা মনে করছেন, এই পরিবর্তন ঐতিহাসিকভাবে ভূ-রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা সমস্যা নিয়ে জর্জরিত “সেভেন সিস্টার্স” খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বিরূপ প্রভাব ফেলে পারে। জাতিগত বিভেদ, বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা, এবং সীমান্ত অস্থিরতার কারণে এই অঞ্চল বরাবরই ভারতের জন্য একটি দুর্বল অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি এই অঞ্চলে ভারতের অবস্থান দুর্বল করতে পারে। বিশেষ করে, যদি পাকিস্তান বা চীন বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ের উত্তেজনা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে নতুন পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের নির্লজ্জ পতনের পর থেকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়াদি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান মিথ্যাচার, আন্দোলনকে মৌলবাদী উত্থান হিসেবে চিত্রিত করার অপচেষ্টা, ১ ডিসেম্বর ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলা। এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নেতাদের মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিকর মন্তব্য যেন থামছেই না। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের এক নেতা বলেছেন, আমার কাছে খবর আছে, কলকাতা দখল করার জন্য ঢাকা থেকে ৩ লাখ হাতে টানা রিকশা রওনা দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশে হাতে টানা রিকশার অস্তিত্ব নেই। ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় দুই দেশের সম্পর্কে বাঁধার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারত যদি দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ না করে, তবে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য ও পরিবহন চুক্তিগুলোতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে ভারতকে কেবল আওয়ামী লীগের প্রতি নির্ভরশীল থাকার কৌশল থেকে সরে আসতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব প্রকাশ না করে, বহুদলীয় কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ভারতের উচিত বাংলাদেশের জনগণের অনুভূতি ও সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করা, আধিপত্যবাদী নীতি পরিহার করে সমতা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে মনোযোগ দেওয়া।
পাকিস্তান ও চীনের ভূমিকা
বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উষ্ণতা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, যা ভারতের জন্য আরও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। পাকিস্তান এবং চীন উভয়ই নিজেদের কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে মজবুত করার চেষ্টা করছে। এই দুই শক্তির প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও শক্তির ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যখন অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে, ঠিক তখনই নেপাল চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে নয়াদিল্লির উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলছে। নেপালে চীনের বিনিয়োগ শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবে নেপাল-ভারত সম্পর্ককে দুর্বল করছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার মাধ্যমে বার্তা দিচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলো আর ভারতের প্রভাবমুক্ত হয়ে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে আগ্রহী।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে শত্রুতা, সংঘাত এবং পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যে গড়ে উঠেছে। কাশ্মীর ইস্যু থেকে শুরু করে ক্রস-বর্ডার সন্ত্রাসবাদ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস বহু পুরোনো। ভারতের অভিযোগ, পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, যা ভারতের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। একইভাবে, চীনও ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য কাজ করছে।
বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে, তবে এটি ভারতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
প্রত্যাশা
বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরিবর্তন একটি স্বতন্ত্র ও বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য এটি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের উষ্ণতা শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন হবে ভারসাম্য বজায় রাখা, যাতে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফাঁদে না পড়ে। বাংলাদেশের এই নতুন ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ হলেও, এটি একটি সুযোগও বটে। যার ফলে, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে।
লেখক: শেখ রিফাদ মাহমুদ
নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ চিত্র
চেয়ারম্যান, এসআরআই ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন।