
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল প্রেরণা ছিল ‘জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠ’। অথচ স্বাধীনতার অর্ধশতক পর আজ বাংলাদেশে সেই জনগণের অধিকার, বিশেষ করে ভোটাধিকার, সবচেয়ে বেশি পদদলিত।
২০০৭ সালে ১/১১-পরবর্তী সেনা-সমর্থিত সরকারের মাধ্যমে শুরু হয় এক বৃহৎ রাজনৈতিক অপকৌশলের। এর মূল লক্ষ্য ছিল নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে থেকে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল কাঠামোকে ধ্বংস করা এবং একটি নিয়ন্ত্রিত, নির্দেশিত, পশ্চিম-অনুমোদিত তথাকথিত ‘স্ট্যাবল’ সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এই অপকৌশল সফল করতে তারা প্রথমেই সে সময়ের চার দলীয় জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এই কৌশলে জনগণ সাড়া দেয়নি। যদিও পরবর্তীতে জানা যায় সে সময় ১/১১ সরকারের সাথে আপোষ করে শেখ হাসিনা। এবং তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিষ্ঠিত হয়। এরপর শুরু হয় আরও চতুর, সুপরিকল্পিত অপারেশন নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর পূর্ণ দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল একটি গণতন্ত্রহীনতার সবচেয়ে বড় মোড়। ১৫৪টি আসনে কোনো ভোটগ্রহণই হয়নি; সেখানে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার নিজেদের অধীনেই ভোট নিয়ন্ত্রণে রাখে। বস্তুত বাংলাদেশ পতিত হয় এক গভীর অন্ধকারে ফাঁদে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ চিত্র আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। রাতের অন্ধকারে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়। শত শত বিরোধীদলীয় প্রার্থীকে প্রচারণা চালাতে দেওয়া হয়নি। গণমাধ্যম ও নির্বাচন কমিশন পরিণত হয় দলীয় কার্যালয়ের উপগ্রহে। বাংলাদেশ পরিণত হয় একটি নির্বাচিত একনায়কতন্ত্রে (ELECTED AUTOCRACY), যেখানে গণতন্ত্রের কঙ্কাল আছে কিন্তু প্রাণ নেই।
একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রতিরোধ একমাত্র বিএনপিই এই নির্বাচনী কারসাজির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক, দৃঢ় ও আত্মত্যাগপূর্ণ লড়াই চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বাড়ি-ঘরে হামলা, পেশাজীবী সংগঠনগুলোর ওপর দমননীতি সত্ত্বেও বিএনপি রাজনৈতিক কাঠামো ধরে রেখেছে। বিএনপির সাথে এই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে কিছু রাজনৈতিক দল সমর্থন দিলেও অধিকাংশ ই ছিল প্রাত প্রদীপের অন্তরালে।
এই আন্দোলন করতে আপোষহীন বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বন্দি জীবনযাপন করেছেন, ছেলে হারা হয়েছেন। জনাব তারেক রহমান নির্বাসনে থেকেছেন। তবুও রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আদর্শিক দিকনির্দেশনা ও সংগঠন পুনর্গঠনে নিরলস কাজ করে চলেছেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি কোনায় ।
বিএনপি ৫ দফা, ১০ দফা, ১ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বাধ্য করতে চেয়েছে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার পথে আসতে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলায় সমাবেশ, পদযাত্রা, মানববন্ধন, অনশন সব কিছুর মধ্য দিয়ে সংগঠিত গণআন্দোলনের ভিত গড়ে তোলে। যার অন্তিম পরিনতি হয় ২৪ এর জুলাই আগষ্ট আন্দোলন। তিলে তিলে রক্ত ঘাম জেল জুলুম নির্যাতনে গড়ে উঠা এই সংগ্রামের যবনিকা হয় ফ্যাসিস্ট হাসিনার দেশ পলায়নের মাধ্যম।
ফ্যাসিস্ট মুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানের জন্য বর্তমানে রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারেক রহমান শুধু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নন, বরং এক বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার ধারক। তাঁর চিন্তা বাস্তববাদী এবং রূপান্তরকামী। ২০২৩ সালের ঘোষিত ৩১ দফা তিনি দিয়েছিলেন ফ্যাসিস্ট আমলে। যা বর্তমানে সর্বমহলে আলোচিত। কারণ নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানে সবাই মৌলিক সংস্কার চায়। ফ্যাসিস্ট পরবর্তী জাতীয় সরকার গঠনে ‘না’ বলা যেমন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি গণতন্ত্রায়নের পথ নকশা ৩১ দফা তৈরির সাহসিকতার নিদর্শন। তিনি প্রমাণ করেছেন, নেতৃত্বের জন্য শুধুমাত্র মাঠে শারীরিক উপস্থিতি নয় আদর্শ, যুক্তি ও দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও বড়। তার হাত ধরেই আজ বিএনপি একটি ধারণাগত ও আদর্শিক রূপান্তরের দিকে এগোচ্ছে। অতীত নির্ভরতা থেকে ভবিষ্যতপ্রবণতা, কৌশলী যুদ্ধ থেকে আদর্শিক সংগ্রাম, দলীয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই থেকে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের চেতনা বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, সামাজিক শান্তি, অর্থনৈতিক ন্যায্যতা সবকিছুই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ, দীর্ঘদিনের ভোটবিহীন শাসন ব্যবস্থা একটি দায়বদ্ধতাবিহীন, জবাবদিহিহীন, লুটপাট নির্ভর রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে। ভোটাধিকার শুধু রাজনৈতিক ইস্যু নয়, এটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি। এই ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা না গেলে প্রশাসন আরও দুর্বৃত্তায়িত হবে, বিচার বিভাগ আরও দলীয় হয়ে উঠবে, রাষ্ট্র আরও শোষণমুখী হয়ে উঠবে এবং জনগণ আরও ভীত, নিঃস্ব, অধিকারহীন হয়ে পড়বে।
বিএনপির এই ১৭ বছরের সংগ্রাম নিছক ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার লড়াই নয়। এটি হচ্ছে একটি জাতিকে তার মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার সংগ্রাম। এটি হচ্ছে সেই ইতিহাসের পুনরুজ্জীবন, যেখানে “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” কেবল আবেগ নয়, বরং একটি নাগরিক অধিকার। আজ বাংলাদেশে যে কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, বিএনপি এবং তার নেতৃত্ব ভবিষ্যতের ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে।
যেদিন প্রথম সূর্যের আলো পড়বে মুক্ত ভোটের বাক্সে, সেদিন শুরু হবে নতুন বাংলাদেশ যেখানে রাষ্ট্র হবে জনগণের, ক্ষমতা হবে সত্যের, আর নেতৃত্ব হবে ন্যায়ের। এই লড়াই যত দীর্ঘই হোক, জয় হবে জনগণের, বিজয় হবে ভোটের, আর রচনা হবে এক নতুন রাষ্ট্রচেতনা জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে।
ডা: এ, কে, এম আহসান হাবীব
চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক